Posted on: May 26, 2024 Posted by: Editor Desk Comments: 1
Spread the love

১৩.৭ বিলিয়ন বছর ধরে টিকে আছে আমাদের এই মহাবিশ্ব। মাঝে কত ছায়াপথ, তার ভিতরে কত নক্ষত্র ঘুরপাক খাচ্ছে, তার হিসেব কষা সোজা কথা? সময়ের ডানায় ভর করে কত তারারা যে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে, আবার সাথে সাথে নতুন নতুন তারা তৈরী হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই যে এত ফাঁকা স্থান মহাবিশ্বের চারপাশে – এক নক্ষত্র থেকে আর এক নক্ষত্র যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে। কোনোকোনো নক্ষত্রদের কেন্দ্র করে ঘুরপাক খাচ্ছে বিভিন্ন আকারের গ্রহরাজিরা। অনেক গ্রহের আবার একের বেশী উপগ্রহ ও আছে। মহাবিশ্ব শুরুর সময় কি এত সব ছিল? হাবল সাহেব তো গণনা করে দেখিয়েছেন সময়ের সাথে ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে সে। তাহলে অদ্দিকালে কেমন ছিল মহাবিশ্বের চেহারা? চলো আজ জানবো সেই বেবি ইউনিভার্স বা শিশু মহাবিশ্বের হাল হকিকত।

সময় রেখা ধরে আমরা যদি পিছিয়ে গেলে দেখতে পেতাম সৃষ্টির শুরুতে মহাবিশ্ব এত বিরাট ছিল না । সে ছিল খুবই উষ্ণ ও এর ঘনত্ব ছিল অনেক বেশী। তারপর সময়ের সাথে সাথে যত সম্প্রসারিত হয়েছে, এর তাপমাত্রা তত হ্রাস পেয়েছে। পিছনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে যদি আমরা প্রথম বিস্ফোরণ, অর্থাৎ বিগ ব্যাং এর ৫০০ হাজার বছর পরে পৌছায়, তাহলে দেখতে পাবো মহাবিশ্বের তাপমাত্রা সে সময় ছিল ৪০০০ ডিগ্রী কেলভিন। সাধারণত কোনো শীতল নক্ষত্রের তাপমাত্রা এরকম থাকে। এই তাপমাত্রাতেই নক্ষত্রদের কেন্দ্রের পরমাণুদের মাঝে এত ঠোকাঠুকি বেড়ে যায় যে, ইলেকট্রন গুলো নিউক্লিয়াসের মায়া কাটিয়ে বেরিয়ে আসে। নিস্তড়িৎ পরমাণু গুলো আয়নে পরিণত হয়। ফলে সেইসময় মহাবিশ্ব থেকে যে বিকিরণ নির্গত হয়, তার চরিত্র দৃশ্যমান আলোর মতোই। প্রকৃতিতে থাকা মুক্ত ইলেকট্রনের সাথে অনবরত ধাক্কাধাক্কির ফলে সেই বিকিরণ আয়নিত গ্যাসীয় মাধ্যমে অনবরত বাধা পায় বলে বেশী দূর এগোতে পারে না।

সময় সারণী বেয়ে যদি আমরা আরো পিছিয়ে যাই, এই ধরো মহাবিস্ফোরণের দশ বছরের মধ্যে, তাহলে দেখতে পাবো মহাবিশ্বের তাপমাত্রা আরো বেশী-তা প্রায় মিলিয়ন ডিগ্রী সেলসিয়াস। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন, এত উচ্চ উষ্ণতায় মহাবিশ্ব থেকে যে বিকিরণ নির্গত হয়, তার অধিকাংশই এক্সরে। সময় সারণী বেয়ে আরো পিছিয়ে যদি একবার আমরা মহাবিস্ফোরণের পর মাত্র ১৫ সেকেন্ড পর পৌঁছালে দেখতে পাবো মহাবিশ্বের তাপমাত্রা প্রায় কয়েকশ কোটি ডিগ্রী সেলসিয়াস! আমাদের সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা যেখানে দেড় কোটি ডিগ্রী সেলসিয়াস, তাতেই এত উত্তাপ। এই সময় পরমানুর নিউক্লিয়াস গুলো প্রোটন ও নিউট্রন কে নিয়ে তাদের সংসার আর ধরে রাখতে পারে না। প্রোটন ও নিউট্রন গুলো নিউক্লিয়ার বলের টান ছিন্ন করে তখন মুক্ত। এই সময়ের মহাবিশ্বের ঘনত্ব অনেক বেশী। সেই সময়ে অত্যধিক সংকোচনের দরুণ ঘনত্ব সাংঘাতিক ভাবে কমবে সেটাই স্বাভাবিক। মহাবিশ্বের ঘনত্ব সে সময় প্রায় সীসার ঘনত্বের চেয়ে বেশী।
এভাবে পেছাতে পেছাতে যদি আমরা মহা বিস্ফোরণের পর এক সেকেন্ডের দশ হাজার ভাগের এক ভাগ সময় অর্থাৎ ১/১০০০০ সেকেন্ডে পৌছায়, তখন দেখতে পাবো, মহাবিশ্বের তাপমাত্রা ট্রিলিয়ন ডিগ্রী সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। সুপারনোভা বিস্ফোরণের সময় ও এত তাপমাত্রা তৈরী হয় না। কল্পনাতীত এই তাপমাত্রায় প্রোটন, নিউট্রন গুলো আর নিজেদের আস্ত রাখতে পারে না- কোয়ার্কে(মৌল কণাদের গঠনগত উপাদান) ভেঙে যায়। এরপর আরো পিছিয়ে যদি আমরা ১০-৪৩ সেকেন্ড পরে, মানে এক সেকেন্ডের ১০৪৩ সেকেন্ডের এক ভাগে পৌছাতে পারি, তাহলে দেখতে পাবে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা গিয়ে পৌঁছেছে ১০৩২ ডিগ্রী সেলসিয়াস, অর্থাৎ ১০০ মিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডিগ্রী সেলসিয়াস! আমাদের চেনা পদার্থবিদ্যার সূত্র গুলি এই সময় আর খাটে না। পদার্থবিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের স্রষ্টা কালজয়ী জার্মান পদার্থবিদ, ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের নামানুসারে এই সময়ের নাম দেন ‘প্ল্যাঙ্ক টাইম’, আর যে কল্পনাতীত তাপমাত্রায় এইরকম অদ্ভুতুড়ে পরিস্থিতির তৈরী হয়, তার নাম দেন ‘প্ল্যাঙ্ক টেম্পারেচার’।

এত উচ্চ তাপমাত্রায় কেনো খাটে না পদার্থবিদ্যার সব নিয়মকানুন? তা জানতে গেলে আমাদেরকে আধুনিক পদার্থবিদ্যার দুই স্তম্ভের ব্যপারে জানতে হবে, একটি হচ্ছে আপেক্ষিকতা বাদ, আর অন্যটি কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। সেই ছোটবেলা থেকেই আমরা নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র পড়ে আসছি- এই মহাবিশ্বের যে কোনো দুটি বস্তু একে অপরকে কত বল দিয়ে আকর্ষণ করে তার হিসাব নিকেষ।বস্তুর ভর বাড়তে বাড়তে বিশালাকার ধারণ করলে তার কাছাকাছি থাকা স্থান-কাল বেঁকে যায়, নিউটনের সুত্র দিয়ে তার ব্যাখ্যা সম্ভব হচ্ছিল না। দিশা দেখালেন আইনস্টাইন। অবশেষে, তাঁর কালজয়ী সাধারণ আপেক্ষিকতা বাদ, এসবের ব্যাখ্যা দিতে সামর্থ্য হোলো।প্রচণ্ড ভারী বস্তুর টানে, তার পাশ দিয়ে যাওয়া আলোক রশ্মি ও কেনো বেঁকে যায়, এসব রহস্যের উত্তর মিললো। ভারী বস্তুর মধ্যেকার আকর্ষণ তো ব্যাখা করা গেলো আইনস্টাইনের আবিষ্কার দিয়ে, কিন্ত খুব ক্ষুদে বস্তুগুলোর অদ্ভুত গতির বেলায় কি হবে? সে উত্তর দিতে পারে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। পরমাণুর ভিতরকার সদস্যরা কিভাবে চলে, এ তারই নিয়ম মালা। পদার্থবিদ্যার অন্যতম মজার এই বিষয়ের সফল ব্যাখ্যার ওপর ভর করে গড়ে উঠেছে পরমাণু গঠনের আধুনিক নিয়মাবলী।
মহাবিশ্ব যখন প্ল্যাঙ্ক তাপমাত্রায় ছিল, সেই সময়ের হিসাব কানুন ব্যাখা করতে গেলে উপরোক্ত দুই স্তম্ভকে হাত মেলাতে হবে। আইনস্টাইন, তাঁর জীবদ্দশায় দীর্ঘ সময় ব্যায় করেছিলেন এই কাজে, কিন্ত সফল হতে পারেন নি। সেই প্রচেষ্টা এখনো চলছে বিজ্ঞানী মহলে। প্ল্যাঙ্ক তাপমাত্রায় পদার্থবিদ্যার উপরোক্ত দুই স্তম্ভ পরস্পর বিরোধী ঘটনার আভাস দেয়। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটি মূল তত্ত্ব হলো আলোর দ্বৈত চরিত্র- অর্থাৎ আলো কখনো তরঙ্গ, আবার কখনো কণার মত আচরণ করে। প্ল্যাঙ্ক তাপমাত্রায় আলোর কণারা নিজেরা জোট বেঁধে একটা ছোট সাইজের কৃষ্ণ গহ্বর তৈরী করে। অর্থাৎ আলো বন্দী হয়ে যায়। কি অদ্ভুত অবস্থা! এই ব্যাখ্যা মেনে না নিয়ে আমরা কি বলতে পারি, যে প্ল্যাঙ্ক তাপমাত্রা ভিত্তিহীন? বরঞ্চ বলা যায়, এইরকম চরম অবস্থায় কি ঘটেছিল, সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনও একমত হতে পারেন নি।
মহাবিশ্ব যে ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে, তা বিস্ফোরণের ১০-৪৩ সেকেন্ড পর থেকে শুরু । একদল বিজ্ঞানী মনে করেন , এই সম্প্রসারণের জন্য মহাবিশ্বের ঘনত্ব বিশেষ পরিবর্তন হচ্ছে না। যতই প্রসারিত হোক না কেনো বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের ঘনত্বের কোনো হ্রাস নেই। এমনকি যদি অনন্ত কাল ধরে বাড়তে ও থাকে , তাতেও কোনো অসুবিধা নেই। এই মতবাদকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ইনফ্লেশন থিওরি বা স্ফিত মতবাদ। কেমন লাগছে না মহাবিশ্বের ঘনত্বের এই ব্যখ্যা? সত্যি কি মহাবিশ্বের ঘনত্ব ধ্রুবক? পরের পর্বে আমরা জানার চেষ্টা করবো সে সব কথা।

———————————————————————

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: 1. Astrophysics for people in a hurry by Niel de Grase Tyson
2. The first three minutes… Steven Wienberg.

লেখক পরিচিতি: শামীম হক মণ্ডল, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিচার সহায়ক বিজ্ঞান পরীক্ষাগারের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে কর্মরত এবং আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের গবেষক। ভালোবাসেন মাতৃ ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার কথা বুনতে ।

যোগাযোগ: shamimmondal709@gmail.com


Spread the love

1 people reacted on this

  1. অত্যন্ত সুন্দর একটি ।

    অনেক ধন্যবাদ লেখককে।

Leave a Comment