
‘সিয়াং আপার মাল্টিপারপাস প্রজেক্ট (SUMP)’ – অরুণাচল প্রদেশের সিয়াং নদীর ওপর একটি ১১,০০০ মেগাওয়াটের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, যা ভারতের বৃহত্তম বাঁধ প্রকল্পগুলোর মধ্যে পড়ে। সরকারের দাবি – এই বহুমুখী প্রকল্পটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জল সংরক্ষণ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পরিকল্পিত। কিন্তু বাস্তবে এই প্রকল্প অরুণাচলের প্রকৃতি পরিবেশের ভারসাম্য, সামগ্রিক বাস্তুতন্ত্র এবং আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলের মানুষদের জীবন জীবিকা ও যাপনের ওপর এক ভয়ানক প্রভাব ফেলবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
আদিবাসী জনগণ সহ পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা কেন এই প্রকল্পের বিরোধিতা করছেন?
জমি ও সংস্কৃতির ধ্বংস : আদি জনগোষ্ঠীর মতে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে তাদের ঐতিহ্যগত ভূমি, কৃষি ব্যবস্থা এবং সাংস্কৃতিক-আধ্যাত্মিক সম্পর্ক চিরতরে হারিয়ে যাবে।
পরিবেশগত বিপর্যয় : নদীর ওপর এই বৃহৎ বাঁধ স্থাপন করলে জীববৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক প্রবাহ ও আবহাওয়াগত ভারসাম্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সামরিকীকরণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন : কেন্দ্রীয় বাহিনীর মোতায়েন স্থানীয়দের হুমকির মধ্যে ফেলেছে। তাঁরা শঙ্কিত। আন্দোলনকারীদের মতে, প্রকল্পটি জোরকরে
চাপিয়ে দেওয়ার একধরনের দমনমূলক কৌশলের জন্যই সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি।
জনসন্মতি ছাড়া উন্নয়ন পরিকল্পনা : স্থানীয় জনগণের পূর্ণ সম্মতি ছাড়া প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শুরু করা হয়েছে, যা আদিবাসী অধিকার লঙ্ঘনের সামিল বলেই আন্দোলনকারীরা মনে করেন। এবং এইভাবে স্থানীয় মানুষ বা গ্রামসভার সম্মতি ছাড়া প্রকল্প রূপায়ণ ভারতবর্ষের বর্তমান পরিবেশ আইনের বিরোধী।

‘সিয়াং ইন্ডিজেনাস ফার্মার্স ফোরাম (SIFF)’ এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। স্থানীয় মানুষদের এক বড় অংশ এই আন্দোলনের সমর্থনে ও প্রকল্প বাতিলের দাবিতে পথে নেমেছেন। স্থানীয় গ্রামবাসীরা বিক্ষোভ মিছিল, প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি প্রদান, জনসমাবেশ এবং বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়ে চলেছেন।
বিক্ষুব্ধ জনগণ সম্প্রতি একটি সেতুতে আগুন লাগিয়ে দেন। সরকারি সভায় বিরোধিতার পাশাপাশি তাঁরা রাজ্যের মন্ত্রীকে লক্ষ্য করে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখিয়েছেন। এই প্রেক্ষিতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (NHRC) স্বতঃপ্রণোদিতভাবে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে।
আন্দোলনের দাবি সমূহ :
সেনা ও আধা-সামরিক বাহিনী অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।
প্রকল্পে আদিবাসী জনগণের পূর্ব সম্মতি নিশ্চিতকরণ করতে হবে এবং পূর্ণ সম্মতি ছাড়া প্রকল্পের কাজ শুরু করা যাবেনা।
পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন (EIA) প্রকাশ করতে হবে।
এই প্রকল্প সম্পূর্ণ বাতিল করে প্রয়োজনে বিকল্প পরিবেশবান্ধব শক্তিপ্রকল্প বিবেচনা করতে হবে সরকারকে।
ভারতবর্ষ সহ নানান দেশের একগুচ্ছ বড় বাঁধের কার্যকারিতা, যৌক্তিকতা ও এর বিপদ সম্পর্কে বিজ্ঞানী ও পরিবেশ কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন তুলছেন। বড় জলাধার নির্মাণ ও তার ফলে নদীর প্রবাহের পরিবর্তন, নিম্ন অববাহিকায় নদীর গতি রুদ্ধ হওয়া, মৎস্যজীবীদের ভয়ঙ্কর সংকট, জলাধারে পলি জমে জমে জলাধারের জলধারণ ক্ষমতা দিন দিন কমছে। বড় বড় সব ড্যাম থেকে একসাথে প্রচুর পরিমাণে জল ছাড়তে বাধ্য হওয়ার ফলে প্রতিবছর দেশের বিস্তৃর্ণ অঞ্চল বন্যা কবলিত হচ্ছে। এসবই এখন যেন নিউ নরম্যাল। বড় বাঁধের এইসব ক্ষতিকারক দিক নিয়ে ভারতবর্ষের মতো দেশের নানান অঞ্চলে প্রচুর বিক্ষোভ প্রতিবাদ লক্ষ্য করেছি আমরা। ঠিক এই আবহে নতুন করে আবার একটি বড় বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা কেন, এর জবাব সরকার প্রশাসনকে দিতেই হবে। খুব সংগত কারণেই মানুষ প্রতিবাদের রাস্তায় নেমেছেন। এ লড়াই আমার, আপনার, সকলের। আসুন, দুর থেকে হলেও এই আন্দোলনের সমর্থনে আমরা রাস্তায় নামি।
প্রতিবেদনে : সন্তোষ সেন, ৪ঠা মে, ২০২৫
[পাঠকের প্রতি বিশেষ অনুরোধ লেখাটি পড়ে অবশ্যই মূল্যবান মতামত কমেন্ট বক্সে দেবেন ।]