
প্রথম থেকেই আমরা জেনে আসছি, মহাবিশ্ব ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে, কিন্ত প্রশ্ন আসতেই পারে সম্প্রসারিত হয়ে যাচ্ছে কোথায় ? স্থান বিষয়ে আমাদের পরিচিত ধারণা থেকে এটা অনুধাবন করা কঠিন। আসলে এই প্রসারণের ফলে তাদের মধ্যেকার দূরত্ব বাড়ছে ক্রমাগত। তোমরা জেনে অবাক হবে, আমাদের এই মহাবিশ্বের মাঝে প্রচুর ফাঁকা জায়গা। এক একটা ছায়াপথের মধ্যে যোজন যোজন ব্যবধান! বিজ্ঞানীরা গণনা করে দেখেছেন, মহাবিশ্বের যে সমস্ত তারা, গ্রহ, গ্রহাণুপুঞ্জ রয়েছে সব কিছু মিলিয়ে ঝিলিয়ে ৩x১০^৫৫ কেজির বেশী হবে না। পদার্থবিজ্ঞানীরা গবেষনা করে দেখেছেন এই মহাবিশ্বের ঘনত্ব ওই মেরে কেটে ৯x১০^-২৭ কেজি/ মিটার^3-অর্থাৎ দশমিকের পরে সাতাশটা শূন্য, তারপর গিয়ে মান। তাহলেই বোঝো, কতটুকুই বা পদার্থ আছে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে। সবখানেই তো প্রায় শূন্যস্থান!তাও আবার গ্রহ, নাক্ষত্র, নক্ষত্রপুঞ্জ, আন্তঃ নাক্ষত্রিক মাধ্যম সব কিছু মিলে মাত্র ৫% জায়গা জুড়ে আছে মহাবিশ্বের। আর বাকি সব তো অচেনা পদার্থ ও শক্তি-যাদের বলা হয় ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি, সামনের পর্বে তোমরা এগুলি জানবে।
আসলে বিজ্ঞানীদের ধারণা মহাবিশ্বের ছুটে চলার ঘটনা, মহাবিস্ফোরণের ১০^-৪৩ সেকেন্ড পর থেকে শুরু। এই সময় প্ল্যাঙ্ক তাপমাত্রার চেয়েও কম তাপমাত্রায় মহাবিশ্বের ফাঁকা জায়গার মধ্যে অদ্ভুত সব কান্ডকারখানা লক্ষ করা যায়। সেই সময় কণা ও প্রতিকণাদের উৎপত্তি ও বিনাশ চলে অনবরত। গবেষণাগারে ও তার হদিশ মিলেছে। গোদা বাংলায় বললে, কণা ও প্রতিকণাদের দৌরাত্ম্যে শূন্যস্থানের মধ্যে কিছু ভরের কানাকড়ি জোটে মহাবিশ্বের ভাগ্যে। পদার্থবিদরা এইসব শূন্যস্থানের গালভারী নাম দিয়েছেন -‘ফলস ভ্যাকুয়াম’ বা ‘ভ্রান্তিকর ফাঁকা জায়গা’, যার প্রকৃতি ভারী অদ্ভুত – প্রসারণ হলেও ঘনত্বের নাকি কোনো তারতম্য হয় না! এই শূন্যস্থানের আয়তন যত বাড়বে, ততই এর শক্তিও বাড়বে। তাপগতিবিদ্যার প্রাথমিক ধারণায় আমরা দেখেছি, পিষ্টনের গ্যাস প্রসারিত হলে, বাতাস ওর ওপর চাপ সৃষ্টি করে কাজ করে, ফলত নিজের শক্তি হারায়। ফলস ভ্যাকুয়ামের বেলায় আবার উল্টো ঘটনা ঘটে। এখানে ঋণাত্মক চাপ তৈরী হয়, সেজন্যে প্রসারণের ফলে সৃষ্ট কাজও হয় ঋণাত্মক-যার দরুণ শক্তির প্রবাহ হয় অন্তর্মুখী।
এই ‘ফলস ভ্যাকুয়াম’ নিয়ে গঠিত মহাবিশ্বের ঘনত্ব সব সময় ধ্রুবক থাকবে, তা সে যতই প্রসারিত হোক না কেনো। মহাকাশবিদ্যার চর্চায় এরই নাম ‘ইনফ্লেশন থিওরি’ বা ‘স্ফীত মতবাদ’-এর ওপর ভিত্তি করেই বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন সম্প্রসারণের জন্য পদার্থ সুষমভাবে বণ্টিত হয়।যদিও কোয়ান্টাম বলবিদ্যানুসারে পদার্থের বণ্টন সব সময় যে সুষম হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আসলে মহাশূন্য ও তার মধ্যস্থ শক্তির পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার ফলে সেখানে ছোট ছোট কম্পন বা তরঙ্গের সৃষ্টি হয়। অতিসূক্ষ্ম স্তরে, যদিও এই অবলোকন করা কঠিন। কিন্ত মহাবিশ্বের প্রসারণের সাথে সাথে এই কম্পনের বিস্তার এত বেশী হয়ে পড়ে, যে গ্যালাক্সিদের মত বিরাটকার মহাজাগতিক বস্তুর সৃষ্টি হয়। স্ফীত মতবাদের প্রবক্তা ও অনুসারীরা যদিও এই বিষয়ে একমত নন।মহাকাশ চর্চার কিছু দিকপালদের ধারণা- প্রথম বিস্ফোরণের পর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু পদার্থ পিণ্ড মহাকর্ষের টানে জড় হয়ে গ্যালাক্সিদের জন্ম।
মহাবিশ্বের ঘনত্বের এই তারতম্যের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একদল জ্যোতির্বিদরা ‘মহাজাগতিক রজ্জু’ বা ‘কসমিক স্ট্রিং’ এর ধারণা দেন। এই স্ট্রিং গুলোকে আমরা সচরাচর দেখতে পাই না। অত্যন্ত উচ্চ তাপমাত্রায় এই ধরণের রজ্জুগুলি তৈরী হয়, এদের ঘনত্ব ও সাংঘাতিক বেশী(মাইল খানেক লম্বা রজ্জুর ভর প্রায় পৃথিবীর ভরকে টেক্কা দেবে)।অত্যাধিক ভারী এই রজ্জুগুলি আবার স্থির নয়, তারা অনবরত দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে, আর এদের দোলন থামানো প্রায় অসম্ভব। ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর (প্রচণ্ড মজার এই মহাজাগতিক বস্তুটি নিয়ে অন্য পর্বে কথা বলা যাবে) যেমন সব কিছুকে নিজের দিকে টেনে নেয়, মহাজাগতিক এইসব রজ্জুর ও এইধরনের প্রবণতা রয়েছে। এরা আবার আকারে ক্ষুদ্র হলে ক্রমশ ক্ষয়ে ক্ষয়ে এক বিশেষ বিকিরণে পরিণত হয়। আমাদের ছায়াপথে যদিও এদের আস্তিত্ত্ব এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না-অতীতে থাকলেও থাকতে পারে।মহাবিশ্বের অগণিত গ্যালাক্সির ভিড়ে হয়তো কোথাও তিকে আছে এই রজ্জু।আশা করা যায় অদুর ভবিষ্যতে গবেষকরা তার সন্ধান পাবেন।
চতুর্থ পর্বের লিঙ্ক :
https://bigyananneswak.org.in/2024/05/26/jyotirbigyaner-khonj-khabor-4th-part/
লেখক পরিচিতি: শামীম হক মণ্ডল, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিচার সহায়ক বিজ্ঞান পরীক্ষাগারের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে কর্মরত। পদার্থবিদ্যায় PhD করেছেন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। গবেষণা করেন লো এনার্জি নিউক্লিয়ার রিয়াকশন ডাইনামিক্স নিয়ে। ভালোবাসেন মাতৃ ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার কথা বুনতে । যোগাযোগ: shamimmondal709@gmail.com
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
1. Astrophysics for people in a hurry by Niel de Grase Tyson
2. The first three minutes… Steven Wienberg.