
বাঙালিদের দ্বারা নাকি ব্যবসা হয় না। সত্যিই কি তাই? ইতিহাস কিন্তু সেই কথা বলে না। অবিভক্ত ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাটের নিকট ভ্যাবলা নামক গ্রামে ১৮৫৪ সালের ২৩ শে জুন জন্ম হয় রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের। পিতা ভগবানচন্দ্র মুখোপাধ্যায় মোক্তারি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। মাত্র ৬ বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। এই সময় ওনার মাতৃদেবী শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরেন। ওনার পিতার এক শুভানুধ্যায়ীর সহায়তায় বারাসাতের একটি স্কুলে ছোট্ট রাজেন্দ্রনাথ ভর্তি হন। ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন পড়াশোনায় তুখোর। সব সময় নিজে থেকে কিছু একটা করব এরকম মনোভাব ওনার মনে ছিল। কলকাতায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে লন্ডন মিশনারি স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হন। অন্য আর পাঁচ জন বাঙালির মতন সেই সময় উনি কোনরকম কোন চাকরির চেষ্টা করেননি বলে ওনার নিকট জনেরা ওনার উপর ক্ষুব্ধ হন। তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য শিবপুর বি.ই কলেজে ভর্তি হন। সেই সময়ে সেই কলেজের সমস্ত পড়াশোনা প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাঙ্গনেই হত। তিন বছর পরে ওনার পড়াশোনা শেষ করার পরেও উনি কোন চাকরির চেষ্টা করেননি। সব সময় উনি ছিলেন স্বাধীনচেতা। অন্যের অধীনে থেকে কোন কিছু করার মনোভাব ওনার মধ্যে ছিল না।
একজন অংশীদারির সঙ্গে যুক্ত হয়ে উনি শুরু করলেন স্বাধীনভাবে ঠিকাদারি ব্যবসা। তদানীন্তন কলকাতা পুরসভার প্রধান ইঞ্জিনিয়ার স্যার ব্রার্ডফোর্ড লেসলি সাহেব রাজেন্দ্রনাথের কাজের প্রতি অগাধ নিষ্ঠা এবং পরিশ্রম দেখে সন্তুষ্ট হয়ে ওনাকে বিভিন্ন কাজের বরাত দিয়ে ওনার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। চূড়ান্ত দক্ষতার সঙ্গে সব কাজ করতে করতেই উনি শুরুর দিকে যে ব্রিটিশ ঠিকাদার কোম্পানির ওভারসিয়ার হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন সেই মার্টিন কোম্পানির সব সময়ের মালিক হয়ে যান।
আজকে আমরা যে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কলকাতার বুকে দেখি সেই সৌধটির নির্মাণ কাজ রাজেন্দ্রনাথ এর তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়েছিল। এছাড়াও ফলতা ওয়াটার ওয়ার্কস, রাজভবনের উল্টো দিকে অবস্থিত এসপ্লানেডের ম্যানশন বি বা দী বাগের চার্টার্ড ব্যাংক বিল্ডিং, মহীশূর রাজপ্রাসাদ প্রভৃতির নির্মাণ কাজও ওনার তত্ত্বাবধানেই হয়। দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে উনি কলকাতার সঙ্গে কৃষিপ্রধান জেলাগুলোকে যুক্ত করার হেতু আমতা, রানাঘাট, বারাসাত বসিরহাট ইত্যাদির সঙ্গে মার্টিন রেলপথ নির্মাণ করেছিলেন।
১৯০১ সালে রাজেন্দ্রনাথ লন্ডনে যান, হাওড়া ব্রিজের নির্মাণকল্পে যে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠিত হয়েছিল তার সভাপতি হয়ে। ১৯৩২ সালে ওনার তত্ত্বাবধানে বেলুড়ে রামকৃষ্ণ মিশন স্থাপনের কাজ হয়। ‘বাঙালির বিশ্বকর্মা’ ওনাকেই বলা হয়। বরাহনগর এ ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট স্থাপনের কাজে সমানে উনি প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যান। বরাবর তিনি তরুন প্রজন্মকে বিজ্ঞান প্রযুক্তি এবং গবেষণামূলক কাজে এগিয়ে আসার জন্য উৎসাহ জুগিয়ে গিয়েছিলেন।
বিধবা মা এবং আত্মীয়রা সম্বন্ধ ঠিক করে একপ্রকার জোড় করেই ওনার সঙ্গে 11 বছর বয়সী যদুমতি দেবীর বিবাহ দিয়ে দেন। এই বাল্যবিবাহের প্রথা মন থেকে কোনদিনই তিনি মেনে নিতে পারেননি। যেকোনো সুযোগেই তাই উনি বাল্যবিবাহের বিরোধিতা করতেন। একজন যষসী বাঙালি শিল্পপতি ও সুদক্ষ ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্বেও বিলাসব্যসনে তিনি নিজেকে আবৃত রাখেননি। সমাজের কল্যাণমূলক কাজে তার অসামান্য অবদান ভুলবার নয়। তার জন্মস্থান বসিরহাট ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের উন্নতি সাধনের হেতু তিনি বহু অর্থ অকাতরে ব্যয় করে ছিলেন।
সম্মানের ঝুলিটি ও রাজেন্দ্রনাথের নেহাত কম নয়। ১৯০৮ সালে রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় Companian of the Order of the Indian Empire (CIE) এর পদে আসীন হন। কলকাতার শেরিফও হয়েছিলেন রাজেন্দ্রনাথ ১৯১১ সালে। ১৯১১ সালেই ওনাকে ইংরেজ সরকার দ্বারা ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এর ঠিক দশ বছর পরে অর্থাৎ ১৯২১ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি তো করেন তিনি। এর দশ বছর পর অর্থাৎ ১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে সাম্মানিক D.Sc ডিগ্রি দেয়। মিশন রো রাস্তাটির নাম পরিবর্তন করে তার নাম অনুসারে বর্তমানে করা হয়েছে আর. এন. মুখার্জি রোড। স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের প্রতি সম্মান জানিয়ে ওনার একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল সৌধ সংলগ্ন উদ্যানে।
এই মহান শিল্পোদ্যোগী মানুষটি ১৯৩৬ সালে ১৫ ই মে চিরনিদ্রার কোলে তলিয়ে যান।
আজকে যখন উদ্যোগপতি বলতেই টাটা, বিড়লা, বাজাজ, আম্বানি, আদানি দের নাম আসে তখন বাঙালির এরকম একজন জ্যোতিষ্ককে অতি অবশ্যই মনে রাখা দরকার। দেশের উন্নতিসাধনে যার অবদান কম নয়।
লেখক : অর্কজিৎ সেন
লেখক একজন উৎসাহী পড়ুয়া এবং লেখক।
লেখকের e-mail ID :- senarkajit557@gmail.com
তথ্যসূত্র :-
১) জনবিজ্ঞানের ইস্তাহার, মার্চ, ২০২৪ (স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় — এক বিস্মৃতপ্রায় বাঙালি শিল্পদ্যোগী / প্রভাতকুমার চট্টোপাধ্যায়)
২) Wikipedia
ছবি সৌজন্য : গুগল
দারুণ একটি লেখা, এরকম আরো লেখা পড়তে চাই।
অনেক ধন্যবাদ লেখককে।