
লিখেছেন: শিবম ব্যানার্জী
যদিও সবকিছুরই শেষ আছে কিন্তু আমরা মানুষেরা কিছু কিছু জিনিস নিজ হাতে কিংবা নিজ কু-কর্মের দ্বারা শেষ করে ফেলি। আমাদের মানুষের প্রবণতা এতটা নিম্নে যে আমরা প্রকৃতিকে ধ্বংস করতে দুইবারও চিন্তা করি না। কু-কর্মের দ্বারা খুব সহজেই আমরা পৃথিবীকেও ধ্বংস করে দিতে পারি। আমরা মানুষেরা প্রকৃতির অংশ হয়ে নিজেদের প্রকৃতির ওপরে মনে করি। আমাদের চোখের সামনে প্রকৃতির বহু অংশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে তবুও আমরা অন্ধের ন্যায় এই পরিবেশে বিচরণ করছি। ঠিক এমনভাবে একটি নদীর কথা এই লেখার আলোচনার বিষয়বস্তু।
প্রথমত বলা যায় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নদী বিশেষ ভূমিকা নেয় ও পরিবেশকে সবুজে ভরে তুলতেও নদীর ভূমিকা অসীম। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার ঝাড়খণ্ড সীমানাবর্তী একটি গ্রাম সাহাবাদ। সেখানে কুশ গাছের বন থেকে সৃষ্টি হয়েছে এক নদী, যার নাম কুশকণী। ৩৩ কিমি দীর্ঘ এই নদীটির মোহনা বীরভূম জেলার সদর শহর সিউড়ির নিকট এক গ্রামে, যে গ্রামটির নাম খটঙ্গা। কুশকর্ণী নদীটি মিশেছে বীরভূম জেলারই ময়ূরাক্ষী নদীতে। আজ থেকে প্রায় ২০-৩০ বছর আগে কুশকর্ণী’র চেহারা যেমন সুন্দর ছিল, আজ আর তা নেই। সেই সুন্দর চেহারা” মানুষের কু-কর্ম বা কু-ব্যবহারের ফলে বর্তমানে অর্ধমৃত। পূর্বে বর্ষাকালে নদীতে যে পরিমাণ বন্যার দর্শন পাওয়া যেত ও যে পরিমাণ বালি নদীতে দৃষ্টিগোচর ছিল, আজ তা সবই বিলীন। বর্তমানের কুশকর্ণী যেন এক নর্দমায় পরিণত হয়েছে। এর থেকে দুঃখময় কিছু হতে পারে না। এই নদী মানুষের জীবিকা নির্বাহের ভরসা। জেলেদের মাছ ধরা, চাষীভাইদের ফসল উৎপাদনের জন্য নদী থেকে জল নেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। যদিও নদীতে জল নেই বলা যায় না, কিন্তু জলের পরিমাণ অতি কম। প্রায় ৫০-৬০ ফুট প্রস্থ নদীটিতে পলি জমতে জমতে নদীটি প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। বহু আবর্জনা এই নদীতে ফেলার ফলেও নদীটি ভরাট হচ্ছে এছাড়াও কুশকর্ণী’র জল আবর্জনামুক্ত নয়। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে অনেক মানুষ কুশকণী’র জল পানও করে কিন্তু নদীর জল দূষণমুক্ত না হওয়ায় সেই জল পানের পক্ষে বিপজ্জনক। তাই সংকটাপন্ন কুশকর্ণী নদীকে বাঁচানোর জন্য গড়ে তোলা হয়েছে ‘কুশকণী নদী সমাজ’। যেটি কুশকণী নদীর কিনারায় গড়ে তোলা হয়েছে। নদীটি হারিয়ে যাওয়ার পেছনে আরো কিছু বিশেষ কারণ যুক্ত। যেমন, নদীর কিনারায় যেসব ইটভাঁটা গড়ে উঠেছে, সেইসব ইটভাঁটাগুলি তাদের জলের যোগান এই নদী থেকেই নেয়। তবে নদীর এমন অর্ধমৃত অবস্থার জন্য ইটভাটাগুলিও সমানভাবে দায়ী। কারণ ইটভাটাগুলি নদীটিকে প্রচুর পরিমাণে দুষিত করছে। দূষণ নদীর বাস্তুতন্ত্রকে (Ecosystem) খারাপ করে। নদীর উৎসস্থল থেকে রাজনগরের শেষ সীমানা অব্দি নদীর কিনারায় মোট প্রায় ৬ থেকে ৭ টি ইটভাঁটা লক্ষ্য করা যায়। নদীর উৎসস্থল থেকে ১০০ মিটারের মধ্যে একটা কংক্রিটের বাঁধও নির্মাণ করা হয়েছে। এর কারণে জল স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হওয়ার আগেই বাঁধ নির্মাণ করে জল আটকে রাখা হয়েছে। মূলত একথাও বলা যায় যে প্রাকৃতিক কারণে নদী কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে কিন্তু কুশকণী যতটা না প্রাকৃতিক কারণে পরিবর্তন হয়েছে, তার থেকে বেশি হয়েছে মনুষ্যসৃষ্ট কারণে। এছাড়াও প্রগতির কারণেও বলা যায় যে কুশকণী আজ সংকটাপন্ন। কুশকর্ণী নদী বৃষ্টির জলে পুষ্ট নদী, আর বর্তমানে পরিবেশের বড়ো বড়ো বৃক্ষ কেটে ফেলার জন্য বৃষ্টির পরিমাণ অনেক কমে গেছে। কারণ গাছ যতটা জল মাটির নীচ থেকে শোষণ করে, তার ১০ শতাংশ জল সালোকসংশ্লেষে লাগায় ও বাকি ৯০ শতাংশ জল বাষ্পমোচন করে দেয়। এতে বাতাসে জলীয় কণার পরিমাণ বাড়ে ও বাষ্প ঘনিভূত হয়ে জলের কণায় পরিণত “হয় আর ভারি হয়। ফলে বাতাস আর জলের কণা ধরে রাখতে পারে না। পরে তা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে।
বর্তমানে পরিবেশের যা পরিস্থিতি, তাতে বিশেষভাবে মানুষের কু-কর্ম অধিকমাত্রায় দায়ী। প্রকৃতির মার থেকে রক্ষা পাওয়া বর্তমানে এক বহু কঠিন ব্যাপার। মানুষ একসময় বহু গাছ কেটেছে আর তার ফল ভোগ বর্তমানে করছে, ঠিক একইভাবে মানুষ যদি পরিবেশের নদীগুলির প্রতিও নির্যাতন করে, তার ফলও মানুষকে ভোগ করতে হবে। শুধুমাত্র কুশকর্ণী নদী নয়, আরও বহু নদী আজ অর্ধমৃত অবস্থায়।