
(এক)
“প্রাতিষ্ঠানিক জালিয়াতি” কাকে বলে? “সিস্টেমেটিক ফ্রড” কী ? দেশের উচ্চ আদালত পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিকে কেন ‘প্রাতিষ্ঠানিক জালিয়াতি’ বলল ? “প্রাতিষ্ঠানিক জালিয়াতি”র শুরু, বিকাশ ও পরিণতি’র কথা জানতে পারলে জনগণের পক্ষে আটকানো ও প্রতিরোধ করা সহজ হবে।
খবরে প্রকাশ, “মঙ্গলবার মামলার শুনানি চলাকালীনই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় রাজ্যের আইনজীবীর উদ্দেশ্যে বলেন- ‘সরকারি চাকরি বর্তমান সময়ে খুবই কম এবং এতেও যদি মানুষের আস্থা চলে যায় তারপর আর কী অবশিষ্ট থাকে। যা বোঝা যাচ্ছে তা হলো এটা একটি প্রাতিষ্ঠানিক জালিয়াতি (সিস্টেমেটিক ফ্রড)। সরকারি চাকরি একটা সামাজিক নিশ্চয়তার আঙ্গিকে দেখা হয়। সরকারি চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়াই যদি কালিমালিপ্ত হয় তবে আস্থা হারিয়ে ফেলবে।”(সূত্র : গণশক্তি। ৮ মে ২০২৪)।
আনন্দবাজার লিখেছে, প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের পর্যবেক্ষণ “সরকারি চাকরি এমনিতেই দুর্লভ। তার মূল্য মানুষের কাছে অনেক। কারণ, মানুষ সরকারি চাকরিকে সামাজিক উন্নতির পথ হিসেবে দেখেন। সেই সরকারি নিয়োগে যদি এমন অনিয়ম হয়, তা হলে মানুষের আস্থাই চলে যাবে। এটা ‘সিস্টেমিক ফ্রড’। যদি সরকারি নিয়োগও কালিমালিপ্ত হয়, তা হলে আর গোটা ব্যবস্থায় কী পড়ে থাকবে? মানুষ যদি আস্থা হারায়, কী ভাবে তার মোকাবিলা করবেন?”(সূত্র : আনন্দবাজার। ৮ মে ২০২৪)
(দুই)
সমাজ বিজ্ঞান ও রাজনীতি বিজ্ঞান থেকে আমরা শিখেছি যে, “যে কোনো নৈতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক বচন, ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতির পেছনে কোনো না কোনো শ্রেণীর স্বার্থ আবিষ্কার করতে না শেখা পর্যন্ত, লোকে রাজনীতির ক্ষেত্রে চিরকাল প্রতারণা ও আত্মপ্রতারণার নির্বোধ বলি হয়েছিল এবং চিরকাল তা থাকবেই ।”(লেনিন । মার্ক্সবাদের তিন উৎস ও উপাদান)
এ কী শাসকশ্রেণীর সরকারকে রক্ষা করার জন্য উচ্চ আদালতের বার্তা ? হতে পারে। এ কী শাসকশ্রেণীকে বাঁচিয়ে রাখার পরামর্শ ? হতে পারে। এ কী জনস্বার্থ রক্ষার জন্য সরকারকে পদক্ষেপ বা চিন্তাভাবনা করতে বলা ? একদমই না।
শাসকশ্রেণীর জন্য বিচার বিভাগের এই মূল্যায়ণকে ‘আর্তনাদ’ বলে অভিহিত করা উচিত ! কিন্তু কেন এই আর্তনাদ ? কিসের ভয়ে আর্তনাদ ? কার ভয়ে আর্তনাদ ?
দেশের আইন প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রেণী-নিরপেক্ষ নয়। সুপ্রিম কোর্টও শ্রেণী-নিরপেক্ষ নয়। আদালতের রায় সব সময় শ্রেণী-স্বার্থে জারিত। শাসকশ্রেণীর পক্ষে যে, রায়ের মর্মবস্তু থাকবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনা মরণ পথে চলেছে। সমাজ কাঠামোর বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কলকবজা নড়বড়ে, ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে। দুর্বল হচ্ছে। শত চেষ্টাতেও আর সমাজের যৌবন ফিরবে না !
পশ্চিমবঙ্গের কমবেশী ছাব্বিশ হাজার শিক্ষক ছাঁটাই প্রশ্নে সাম্রাজ্যবাদীদের চাপে একদিকে বিলগ্নিকরণ ও বেসরকারিকরণ আর অন্য দিকে চাপ মেনে, শাসকশ্রেণীর পক্ষে রাষ্ট্রের মালিকানা রক্ষা ও সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা বজায় রাখা। সুপ্রিম কোর্টের সামনে, শাসকশ্রেণী ও জনগণের দ্বন্দ্বে, এ ধরনের আর্তনাদ ছাড়া কীবা করার আছে ? কারণ বর্তমান আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় চাকরি থাকা না থাকার দ্বন্দ্ব অসমাধানযোগ্য !
(তিন)
আজ থেকে কমবেশী আড়াইশো বছর আগে মানব সমাজ শিখেছে “সম্পত্তির অর্থ হল চুরি”(ব্রিসো । ১৭৮৯ )। অন্য ভাবে আমরা বলতে চাই চুরি, দুর্নীতি, অনাচার, অনৈতিকতা, বেআইনী ইত্যাদি কাজের মধ্য দিয়েই আজ সম্পত্তির অধিকারী হয় স্বল্প সংখ্যক মানুষ।
দুর্নীতি ও অনাচার হচ্ছে পুঁজিপতি শাসকশ্রেণীর সহজাত কাজ ও ধর্ম । পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনা পরিচালনার অঙ্গ, অনাচার ও দুর্নীতি হচ্ছে পুঁজিবাদীদের অলঙ্কার ।
দুর্নীতি, অনৈতিকতা, বেআইনী, অনাচার, কেলেঙ্কারি, মানুষ ঠকানো, গণপ্রতারণা, ঘুষ খাওয়া ও দেওয়া, অবৈজ্ঞানিক আচরণ ইত্যাদি ছাড়া পুঁজিপতি শাসকশ্রেণী ও তার রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা এক পাও ফেলতে পারবে না। কথায় আছে, যে যতবড় নেতা সে ততবড় অনাচারী ! এটা পুঁজিবাদী সমাজের চলনের চিরন্তন নিয়ম।
আসলে মানুষের শ্রমের মূল্য আত্মস্বাৎ না করলে কেউ পুঁজিপতি হয় না । বড়লোকদের অলকাপুরী সব সময় সাধারণ ও গরীব মানুষের রক্ত ও শ্রমমূল্যে সজ্জিত হয় । অনাচার ছাড়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এক পাও ফেলতে পারে না।
(চার)
চুরি, দুর্নীতি, অনাচার, অনৈতিকতা, বেআইনী ইত্যাদি কাজের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ বা রাষ্ট্রীয়করণ কী ভাবে ঘটলো ?
১# অচেতন অবস্থায় চুরি। গ্রামাঞ্চলে ষাট বছর আগে চুরির কাহিনী শুনেছি। কিছু প্রত্যক্ষ ভাবে দেখেছি। ছোট ছোট পকেটে চুরি হতো। রাতে মানুষ ঘুমিয়ে পড়লে অচেতন অবস্থায় চোর বা চোরের দল সিঁধ কেটে বা জানালা কেটে বা ঘেরা দেওয়াল টপকে গৃহস্তের সামগ্রী চুরি করে নিয়ে যেত। ঘুম থেকে উঠে বা ঘুম ভেঙে চুরির কথা জানতে পারতেন। এ ধরনের চুরিকে ছিঁচকে চুরি বলা হয়।
২# অন্ধকারে ডাকাতি। ডাকাতদল রাতের অন্ধকারকে চুরির সময় হিসেবে বেছে নিত। দিনে ডাকাতি করলে সবাই ডাকাতদের দেখে ফেলবে বা অন্য গ্রামের মানুষজন ডাকাতি আটকানো বা প্রতিরোধ করবে। এক্ষেত্রে গ্রামে মিটিং হতো, পাহারার ব্যবস্থা হতো, আলোচনা হতো, স্থানীয় ভাবে আপাতত সমাধান হতো।
৩# পকেটমারী। ভীড় বাস, ট্রেন, মেলা, গণসমাবেস ইত্যাদি জায়গাতে পকেটমাররা কী ভাবে চুরি করে ? সজাগ জনগণের মুহূর্তের অসতর্কতার সুযোগে পকেটমার কাজ হাসিল করে। খুবই গোপনে পকেটমারীর কাজটা ঘটে। ধরা পড়লে মারধোর করে জনতা ছেড়ে দেন। স্থানীয় ভাবে চুরির ঘটনা শেষ হয়। এখানেও শাসকদল, পুলিশ ও প্রশাসনের মদত থাকে না।
৪# রাজনৈতিক লুটপাট। গ্রামাঞ্চলের রাজনৈতিক দলের রেষারেষির মধ্যে জনমানুষের বাড়ীঘর লুটপাট হতে দেখেছি। লুটপাটের সামগ্রী, লুটপাটের জায়গাতে, কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতো আর কিছু দামী জিনিস সুযোগ সন্ধানীরা কুড়িয়ে নিয়ে যেত। প্রকাশ্য দিবালোকে ঘটতো লুটতরাজ । এ সব লুটপাটের ঘটনা চুরির জন্য নয়, ঘৃণ্য রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার চেষ্টা। জনগণের মধ্যে ভয় ধরানোর চেষ্টা।
৫# “প্রাতিষ্ঠানিক চুরি বা দুর্নীতি। জনমানুষের সজাগ অবস্থায়, প্রকাশ্য দিবালোকে, জনগণকে অন্ধকারে রেখে, গণমানুষের সামনে ও শাসকদলের সহযোগিতায় গণ লুটপাট। প্রশাসনিক মদতে গণ লুন্ঠন।
বর্তমান অবরুদ্ধ উৎপাদন ও চরম সংকুচিত বিনিময় ও বাজার, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির ক্ষেত্র গড়ে তোলে। রাষ্ট্র ও সরকারকে ব্যবহার করে, শাসকশ্রেণী ও তার রাজনৈতিক দল, সমর্থকদের পুঁজি ও মুনাফা গড়ে তোলা হচ্ছে “সিস্টেমিক ফ্রড”।
——
স্বপন জানা। ১১ মে ২০২৪। কলকাতা।
সৌজন্য : সোসাইটি ফর সোসাল ফার্মাকোলজি।”প্রাতিষ্ঠানিক জালিয়াতি”
সুপ্রিম কোর্টের আর্তনাদ
—-
(এক)
“প্রাতিষ্ঠানিক জালিয়াতি” কাকে বলে? “সিস্টেমেটিক ফ্রড” কী ? দেশের উচ্চ আদালত পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিকে কেন ‘প্রাতিষ্ঠানিক জালিয়াতি’ বলল ? “প্রাতিষ্ঠানিক জালিয়াতি”র শুরু, বিকাশ ও পরিণতি’র কথা জানতে পারলে জনগণের পক্ষে আটকানো ও প্রতিরোধ করা সহজ হবে।
খবরে প্রকাশ, “মঙ্গলবার মামলার শুনানি চলাকালীনই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় রাজ্যের আইনজীবীর উদ্দেশ্যে বলেন- ‘সরকারি চাকরি বর্তমান সময়ে খুবই কম এবং এতেও যদি মানুষের আস্থা চলে যায় তারপর আর কী অবশিষ্ট থাকে। যা বোঝা যাচ্ছে তা হলো এটা একটি প্রাতিষ্ঠানিক জালিয়াতি (সিস্টেমেটিক ফ্রড)। সরকারি চাকরি একটা সামাজিক নিশ্চয়তার আঙ্গিকে দেখা হয়। সরকারি চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়াই যদি কালিমালিপ্ত হয় তবে আস্থা হারিয়ে ফেলবে।”(সূত্র : গণশক্তি। ৮ মে ২০২৪)।
আনন্দবাজার লিখেছে, প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের পর্যবেক্ষণ “সরকারি চাকরি এমনিতেই দুর্লভ। তার মূল্য মানুষের কাছে অনেক। কারণ, মানুষ সরকারি চাকরিকে সামাজিক উন্নতির পথ হিসেবে দেখেন। সেই সরকারি নিয়োগে যদি এমন অনিয়ম হয়, তা হলে মানুষের আস্থাই চলে যাবে। এটা ‘সিস্টেমিক ফ্রড’। যদি সরকারি নিয়োগও কালিমালিপ্ত হয়, তা হলে আর গোটা ব্যবস্থায় কী পড়ে থাকবে? মানুষ যদি আস্থা হারায়, কী ভাবে তার মোকাবিলা করবেন?”(সূত্র : আনন্দবাজার। ৮ মে ২০২৪)
(দুই)
সমাজ বিজ্ঞান ও রাজনীতি বিজ্ঞান থেকে আমরা শিখেছি যে, “যে কোনো নৈতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক বচন, ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতির পেছনে কোনো না কোনো শ্রেণীর স্বার্থ আবিষ্কার করতে না শেখা পর্যন্ত, লোকে রাজনীতির ক্ষেত্রে চিরকাল প্রতারণা ও আত্মপ্রতারণার নির্বোধ বলি হয়েছিল এবং চিরকাল তা থাকবেই ।”(লেনিন । মার্ক্সবাদের তিন উৎস ও উপাদান)
এ কী শাসকশ্রেণীর সরকারকে রক্ষা করার জন্য উচ্চ আদালতের বার্তা ? হতে পারে। এ কী শাসকশ্রেণীকে বাঁচিয়ে রাখার পরামর্শ ? হতে পারে। এ কী জনস্বার্থ রক্ষার জন্য সরকারকে পদক্ষেপ বা চিন্তাভাবনা করতে বলা ? একদমই না।
শাসকশ্রেণীর জন্য বিচার বিভাগের এই মূল্যায়ণকে ‘আর্তনাদ’ বলে অভিহিত করা উচিত ! কিন্তু কেন এই আর্তনাদ ? কিসের ভয়ে আর্তনাদ ? কার ভয়ে আর্তনাদ ?
দেশের আইন প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রেণী-নিরপেক্ষ নয়। সুপ্রিম কোর্টও শ্রেণী-নিরপেক্ষ নয়। আদালতের রায় সব সময় শ্রেণী-স্বার্থে জারিত। শাসকশ্রেণীর পক্ষে যে, রায়ের মর্মবস্তু থাকবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনা মরণ পথে চলেছে। সমাজ কাঠামোর বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কলকবজা নড়বড়ে, ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে। দুর্বল হচ্ছে। শত চেষ্টাতেও আর সমাজের যৌবন ফিরবে না !
পশ্চিমবঙ্গের কমবেশী ছাব্বিশ হাজার শিক্ষক ছাঁটাই প্রশ্নে সাম্রাজ্যবাদীদের চাপে একদিকে বিলগ্নিকরণ ও বেসরকারিকরণ আর অন্য দিকে চাপ মেনে, শাসকশ্রেণীর পক্ষে রাষ্ট্রের মালিকানা রক্ষা ও সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা বজায় রাখা। সুপ্রিম কোর্টের সামনে, শাসকশ্রেণী ও জনগণের দ্বন্দ্বে, এ ধরনের আর্তনাদ ছাড়া কীবা করার আছে ? কারণ বর্তমান আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় চাকরি থাকা না থাকার দ্বন্দ্ব অসমাধানযোগ্য !
(তিন)
আজ থেকে কমবেশী আড়াইশো বছর আগে মানব সমাজ শিখেছে “সম্পত্তির অর্থ হল চুরি”(ব্রিসো । ১৭৮৯ )। অন্য ভাবে আমরা বলতে চাই চুরি, দুর্নীতি, অনাচার, অনৈতিকতা, বেআইনী ইত্যাদি কাজের মধ্য দিয়েই আজ সম্পত্তির অধিকারী হয় স্বল্প সংখ্যক মানুষ।
দুর্নীতি ও অনাচার হচ্ছে পুঁজিপতি শাসকশ্রেণীর সহজাত কাজ ও ধর্ম । পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনা পরিচালনার অঙ্গ, অনাচার ও দুর্নীতি হচ্ছে পুঁজিবাদীদের অলঙ্কার ।
দুর্নীতি, অনৈতিকতা, বেআইনী, অনাচার, কেলেঙ্কারি, মানুষ ঠকানো, গণপ্রতারণা, ঘুষ খাওয়া ও দেওয়া, অবৈজ্ঞানিক আচরণ ইত্যাদি ছাড়া পুঁজিপতি শাসকশ্রেণী ও তার রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা এক পাও ফেলতে পারবে না। কথায় আছে, যে যতবড় নেতা সে ততবড় অনাচারী ! এটা পুঁজিবাদী সমাজের চলনের চিরন্তন নিয়ম।
আসলে মানুষের শ্রমের মূল্য আত্মস্বাৎ না করলে কেউ পুঁজিপতি হয় না । বড়লোকদের অলকাপুরী সব সময় সাধারণ ও গরীব মানুষের রক্ত ও শ্রমমূল্যে সজ্জিত হয় । অনাচার ছাড়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এক পাও ফেলতে পারে না।
(চার)
চুরি, দুর্নীতি, অনাচার, অনৈতিকতা, বেআইনী ইত্যাদি কাজের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ বা রাষ্ট্রীয়করণ কী ভাবে ঘটলো ?
১# অচেতন অবস্থায় চুরি। গ্রামাঞ্চলে ষাট বছর আগে চুরির কাহিনী শুনেছি। কিছু প্রত্যক্ষ ভাবে দেখেছি। ছোট ছোট পকেটে চুরি হতো। রাতে মানুষ ঘুমিয়ে পড়লে অচেতন অবস্থায় চোর বা চোরের দল সিঁধ কেটে বা জানালা কেটে বা ঘেরা দেওয়াল টপকে গৃহস্তের সামগ্রী চুরি করে নিয়ে যেত। ঘুম থেকে উঠে বা ঘুম ভেঙে চুরির কথা জানতে পারতেন। এ ধরনের চুরিকে ছিঁচকে চুরি বলা হয়।
২# অন্ধকারে ডাকাতি। ডাকাতদল রাতের অন্ধকারকে চুরির সময় হিসেবে বেছে নিত। দিনে ডাকাতি করলে সবাই ডাকাতদের দেখে ফেলবে বা অন্য গ্রামের মানুষজন ডাকাতি আটকানো বা প্রতিরোধ করবে। এক্ষেত্রে গ্রামে মিটিং হতো, পাহারার ব্যবস্থা হতো, আলোচনা হতো, স্থানীয় ভাবে আপাতত সমাধান হতো।
৩# পকেটমারী। ভীড় বাস, ট্রেন, মেলা, গণসমাবেস ইত্যাদি জায়গাতে পকেটমাররা কী ভাবে চুরি করে ? সজাগ জনগণের মুহূর্তের অসতর্কতার সুযোগে পকেটমার কাজ হাসিল করে। খুবই গোপনে পকেটমারীর কাজটা ঘটে। ধরা পড়লে মারধোর করে জনতা ছেড়ে দেন। স্থানীয় ভাবে চুরির ঘটনা শেষ হয়। এখানেও শাসকদল, পুলিশ ও প্রশাসনের মদত থাকে না।
৪# রাজনৈতিক লুটপাট। গ্রামাঞ্চলের রাজনৈতিক দলের রেষারেষির মধ্যে জনমানুষের বাড়ীঘর লুটপাট হতে দেখেছি। লুটপাটের সামগ্রী, লুটপাটের জায়গাতে, কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতো আর কিছু দামী জিনিস সুযোগ সন্ধানীরা কুড়িয়ে নিয়ে যেত। প্রকাশ্য দিবালোকে ঘটতো লুটতরাজ । এ সব লুটপাটের ঘটনা চুরির জন্য নয়, ঘৃণ্য রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার চেষ্টা। জনগণের মধ্যে ভয় ধরানোর চেষ্টা।
৫# “প্রাতিষ্ঠানিক চুরি বা দুর্নীতি। জনমানুষের সজাগ অবস্থায়, প্রকাশ্য দিবালোকে, জনগণকে অন্ধকারে রেখে, গণমানুষের সামনে ও শাসকদলের সহযোগিতায় গণ লুটপাট। প্রশাসনিক মদতে গণ লুন্ঠন।
বর্তমান অবরুদ্ধ উৎপাদন ও চরম সংকুচিত বিনিময় ও বাজার, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির ক্ষেত্র গড়ে তোলে। রাষ্ট্র ও সরকারকে ব্যবহার করে, শাসকশ্রেণী ও তার রাজনৈতিক দল, সমর্থকদের পুঁজি ও মুনাফা গড়ে তোলা হচ্ছে “সিস্টেমিক ফ্রড”।
——
স্বপন জানা। ১১ মে ২০২৪। কলকাতা।
সৌজন্য : সোসাইটি ফর সোসাল ফার্মাকোলজি।”প্রাতিষ্ঠানিক জালিয়াতি”
সুপ্রিম কোর্টের আর্তনাদ
—-
(এক)
“প্রাতিষ্ঠানিক জালিয়াতি” কাকে বলে? “সিস্টেমেটিক ফ্রড” কী ? দেশের উচ্চ আদালত পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিকে কেন ‘প্রাতিষ্ঠানিক জালিয়াতি’ বলল ? “প্রাতিষ্ঠানিক জালিয়াতি”র শুরু, বিকাশ ও পরিণতি’র কথা জানতে পারলে জনগণের পক্ষে আটকানো ও প্রতিরোধ করা সহজ হবে।
খবরে প্রকাশ, “মঙ্গলবার মামলার শুনানি চলাকালীনই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় রাজ্যের আইনজীবীর উদ্দেশ্যে বলেন- ‘সরকারি চাকরি বর্তমান সময়ে খুবই কম এবং এতেও যদি মানুষের আস্থা চলে যায় তারপর আর কী অবশিষ্ট থাকে। যা বোঝা যাচ্ছে তা হলো এটা একটি প্রাতিষ্ঠানিক জালিয়াতি (সিস্টেমেটিক ফ্রড)। সরকারি চাকরি একটা সামাজিক নিশ্চয়তার আঙ্গিকে দেখা হয়। সরকারি চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়াই যদি কালিমালিপ্ত হয় তবে আস্থা হারিয়ে ফেলবে।”(সূত্র : গণশক্তি। ৮ মে ২০২৪)।
আনন্দবাজার লিখেছে, প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের পর্যবেক্ষণ “সরকারি চাকরি এমনিতেই দুর্লভ। তার মূল্য মানুষের কাছে অনেক। কারণ, মানুষ সরকারি চাকরিকে সামাজিক উন্নতির পথ হিসেবে দেখেন। সেই সরকারি নিয়োগে যদি এমন অনিয়ম হয়, তা হলে মানুষের আস্থাই চলে যাবে। এটা ‘সিস্টেমিক ফ্রড’। যদি সরকারি নিয়োগও কালিমালিপ্ত হয়, তা হলে আর গোটা ব্যবস্থায় কী পড়ে থাকবে? মানুষ যদি আস্থা হারায়, কী ভাবে তার মোকাবিলা করবেন?”(সূত্র : আনন্দবাজার। ৮ মে ২০২৪)
(দুই)
সমাজ বিজ্ঞান ও রাজনীতি বিজ্ঞান থেকে আমরা শিখেছি যে, “যে কোনো নৈতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক বচন, ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতির পেছনে কোনো না কোনো শ্রেণীর স্বার্থ আবিষ্কার করতে না শেখা পর্যন্ত, লোকে রাজনীতির ক্ষেত্রে চিরকাল প্রতারণা ও আত্মপ্রতারণার নির্বোধ বলি হয়েছিল এবং চিরকাল তা থাকবেই ।”(লেনিন । মার্ক্সবাদের তিন উৎস ও উপাদান)
এ কী শাসকশ্রেণীর সরকারকে রক্ষা করার জন্য উচ্চ আদালতের বার্তা ? হতে পারে। এ কী শাসকশ্রেণীকে বাঁচিয়ে রাখার পরামর্শ ? হতে পারে। এ কী জনস্বার্থ রক্ষার জন্য সরকারকে পদক্ষেপ বা চিন্তাভাবনা করতে বলা ? একদমই না।
শাসকশ্রেণীর জন্য বিচার বিভাগের এই মূল্যায়ণকে ‘আর্তনাদ’ বলে অভিহিত করা উচিত ! কিন্তু কেন এই আর্তনাদ ? কিসের ভয়ে আর্তনাদ ? কার ভয়ে আর্তনাদ ?
দেশের আইন প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রেণী-নিরপেক্ষ নয়। সুপ্রিম কোর্টও শ্রেণী-নিরপেক্ষ নয়। আদালতের রায় সব সময় শ্রেণী-স্বার্থে জারিত। শাসকশ্রেণীর পক্ষে যে, রায়ের মর্মবস্তু থাকবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনা মরণ পথে চলেছে। সমাজ কাঠামোর বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কলকবজা নড়বড়ে, ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে। দুর্বল হচ্ছে। শত চেষ্টাতেও আর সমাজের যৌবন ফিরবে না !
পশ্চিমবঙ্গের কমবেশী ছাব্বিশ হাজার শিক্ষক ছাঁটাই প্রশ্নে সাম্রাজ্যবাদীদের চাপে একদিকে বিলগ্নিকরণ ও বেসরকারিকরণ আর অন্য দিকে চাপ মেনে, শাসকশ্রেণীর পক্ষে রাষ্ট্রের মালিকানা রক্ষা ও সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা বজায় রাখা। সুপ্রিম কোর্টের সামনে, শাসকশ্রেণী ও জনগণের দ্বন্দ্বে, এ ধরনের আর্তনাদ ছাড়া কীবা করার আছে ? কারণ বর্তমান আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় চাকরি থাকা না থাকার দ্বন্দ্ব অসমাধানযোগ্য !
(তিন)
আজ থেকে কমবেশী আড়াইশো বছর আগে মানব সমাজ শিখেছে “সম্পত্তির অর্থ হল চুরি”(ব্রিসো । ১৭৮৯ )। অন্য ভাবে আমরা বলতে চাই চুরি, দুর্নীতি, অনাচার, অনৈতিকতা, বেআইনী ইত্যাদি কাজের মধ্য দিয়েই আজ সম্পত্তির অধিকারী হয় স্বল্প সংখ্যক মানুষ।
দুর্নীতি ও অনাচার হচ্ছে পুঁজিপতি শাসকশ্রেণীর সহজাত কাজ ও ধর্ম । পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনা পরিচালনার অঙ্গ, অনাচার ও দুর্নীতি হচ্ছে পুঁজিবাদীদের অলঙ্কার ।
দুর্নীতি, অনৈতিকতা, বেআইনী, অনাচার, কেলেঙ্কারি, মানুষ ঠকানো, গণপ্রতারণা, ঘুষ খাওয়া ও দেওয়া, অবৈজ্ঞানিক আচরণ ইত্যাদি ছাড়া পুঁজিপতি শাসকশ্রেণী ও তার রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা এক পাও ফেলতে পারবে না। কথায় আছে, যে যতবড় নেতা সে ততবড় অনাচারী ! এটা পুঁজিবাদী সমাজের চলনের চিরন্তন নিয়ম।
আসলে মানুষের শ্রমের মূল্য আত্মস্বাৎ না করলে কেউ পুঁজিপতি হয় না । বড়লোকদের অলকাপুরী সব সময় সাধারণ ও গরীব মানুষের রক্ত ও শ্রমমূল্যে সজ্জিত হয় । অনাচার ছাড়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এক পাও ফেলতে পারে না।
(চার)
চুরি, দুর্নীতি, অনাচার, অনৈতিকতা, বেআইনী ইত্যাদি কাজের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ বা রাষ্ট্রীয়করণ কী ভাবে ঘটলো ?
১# অচেতন অবস্থায় চুরি। গ্রামাঞ্চলে ষাট বছর আগে চুরির কাহিনী শুনেছি। কিছু প্রত্যক্ষ ভাবে দেখেছি। ছোট ছোট পকেটে চুরি হতো। রাতে মানুষ ঘুমিয়ে পড়লে অচেতন অবস্থায় চোর বা চোরের দল সিঁধ কেটে বা জানালা কেটে বা ঘেরা দেওয়াল টপকে গৃহস্তের সামগ্রী চুরি করে নিয়ে যেত। ঘুম থেকে উঠে বা ঘুম ভেঙে চুরির কথা জানতে পারতেন। এ ধরনের চুরিকে ছিঁচকে চুরি বলা হয়।
২# অন্ধকারে ডাকাতি। ডাকাতদল রাতের অন্ধকারকে চুরির সময় হিসেবে বেছে নিত। দিনে ডাকাতি করলে সবাই ডাকাতদের দেখে ফেলবে বা অন্য গ্রামের মানুষজন ডাকাতি আটকানো বা প্রতিরোধ করবে। এক্ষেত্রে গ্রামে মিটিং হতো, পাহারার ব্যবস্থা হতো, আলোচনা হতো, স্থানীয় ভাবে আপাতত সমাধান হতো।
৩# পকেটমারী। ভীড় বাস, ট্রেন, মেলা, গণসমাবেস ইত্যাদি জায়গাতে পকেটমাররা কী ভাবে চুরি করে ? সজাগ জনগণের মুহূর্তের অসতর্কতার সুযোগে পকেটমার কাজ হাসিল করে। খুবই গোপনে পকেটমারীর কাজটা ঘটে। ধরা পড়লে মারধোর করে জনতা ছেড়ে দেন। স্থানীয় ভাবে চুরির ঘটনা শেষ হয়। এখানেও শাসকদল, পুলিশ ও প্রশাসনের মদত থাকে না।
৪# রাজনৈতিক লুটপাট। গ্রামাঞ্চলের রাজনৈতিক দলের রেষারেষির মধ্যে জনমানুষের বাড়ীঘর লুটপাট হতে দেখেছি। লুটপাটের সামগ্রী, লুটপাটের জায়গাতে, কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতো আর কিছু দামী জিনিস সুযোগ সন্ধানীরা কুড়িয়ে নিয়ে যেত। প্রকাশ্য দিবালোকে ঘটতো লুটতরাজ । এ সব লুটপাটের ঘটনা চুরির জন্য নয়, ঘৃণ্য রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার চেষ্টা। জনগণের মধ্যে ভয় ধরানোর চেষ্টা।
৫# “প্রাতিষ্ঠানিক চুরি বা দুর্নীতি। জনমানুষের সজাগ অবস্থায়, প্রকাশ্য দিবালোকে, জনগণকে অন্ধকারে রেখে, গণমানুষের সামনে ও শাসকদলের সহযোগিতায় গণ লুটপাট। প্রশাসনিক মদতে গণ লুন্ঠন।
বর্তমান অবরুদ্ধ উৎপাদন ও চরম সংকুচিত বিনিময় ও বাজার, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির ক্ষেত্র গড়ে তোলে। রাষ্ট্র ও সরকারকে ব্যবহার করে, শাসকশ্রেণী ও তার রাজনৈতিক দল, সমর্থকদের পুঁজি ও মুনাফা গড়ে তোলা হচ্ছে “সিস্টেমিক ফ্রড”।
——
স্বপন জানা। ১১ মে ২০২৪। কলকাতা।
সৌজন্য : সোসাইটি ফর সোসাল ফার্মাকোলজি।