Posted on: April 30, 2024 Posted by: Editor Desk Comments: 0
Spread the love

আগের দিন আমরা জেনেছি, হাবল সাহেব কি করে মেপেছিলেন এই মহাবিশ্বের বয়স। তাছাড়াও আর একটা উপায় অবশ্য আছে – তোমাদের আজ সে কথা বলব। একবার মহাবিশ্বের প্রাচীন বস্তুগুলোর বয়স বার করে ফেলতে পারলে, সেখান থেকে হিসেব কষে বার করা যায়, কত দিন ধরে টিকে আছে এই মহাবিশ্ব ।
এই হিসেব বুঝতে গেলে আমাদের নক্ষত্রদের জীবন-মৃত্যু সম্পর্কে একটু জানতে হবে।কোনো নক্ষত্রের জীবন কত নান্দনিক হবে, তা নির্ভর করে তাদের ভরের ওপর। যার আকার যত বেশী, সে তত তাড়াতাড়ি জ্বালানি খরচা করে। সে দিক থেকে দেখতে গেলে, আমাদের সূর্য বেশ ছোট আকারের নক্ষত্র। তাই তার পতন ও বিশাল বিশাল তারকাদের মতো অত জাঁকজমক নয়। আমাদের সূর্যের চেয়ে দশ গুণ ভরের তারাদের জীবনকাল প্রায় দশ মিলিয়ন বছর! আবার সূর্যের ভরের অর্ধেক ভরের তারারা প্রায় বিশ মিলিয়ন বছর টিকে থাকে।

কোন তারার জ্বালানি কবে শেষ হবে… তাঁদের অন্তিম দশা কি হবে… এসব জানতে গেলে প্রথমে আমাদের জানতে হবে একটি নক্ষত্রের জ্বালানি আসে কোত্থেকে? এ বিষয়ে ১৯২০ সাল নাগাদ ব্রিটিশ জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন প্রাথমিক একটা ধারণা দেন । পরবর্তীকালে, ১৯৩৮-৩৯ সালে জগৎ বিখ্যাত পদার্থবিদ হানস্ বেথে ও ফন উইসজেইকার বলেন তারাদের হেঁশেলের ইন্ধনের যোগান আসে ‘নিউক্লিয়ার ফিউশন’ অর্থাৎ ‘নিউক্লিও সংযোজন’ থেকে। নিউক্লিয়ার সংশ্লেষণের ওপর এই অসামান্য অবদানের জন্যে নোবেল কমিটি, তার প্রায় তিন দশক পরে, ১৯৬৭ সালে বেথেকে পুরুস্কৃত করেন-যাক সে কথা। আমরা বরং দেখি কি সেই ‘নিউক্লিও সংযোজন’?
দুটো হাল্কা পারমানবিক ভর বিশিষ্ট নিউক্লিয়াস মিলিত হয়ে জন্ম দেয় অপেক্ষাকৃত ভারী পরমানুর নিউক্লিয়াস, সাথে মেলে প্রচুর পরিমাণ শক্তি, তাইই জ্বালিয়ে রাখে আমাদের দৃশ্যমান- অদৃশ্যমান সমস্ত তারকাদের। এই ঘটনায় ‘নিউক্লিও সংযোজন’ – এটি শুরু হয় প্রকৃতির সর্বপেক্ষা সরল পরমাণু, হাইড্রোজেন দিয়ে। এই অতি সাধারণ একমাত্র ‘প্রোটন’ বিশিষ্ট পরামানুই তারাদের হেঁশেল এর প্রথম খড়ি কাঠ! এর পরে আসে দ্বি-‘প্রোটন’ বিশিষ্ট পরমাণু ‘হিলিয়ামের’ পালা- যার কেন্দ্রককে ঘিরে বনবন করে ঘুরতে থাকে দুটি ইলেক্ট্রন। ধনাত্মক আধান বিশিষ্ট প্রোটনগুলো তড়িৎ বিকর্ষণের জন্যে একে অপরকে সহ্য করতে না পেরে পরস্পর থেকে ছিটকে যেতে চায়। তাদেরকে হিলিয়াম পরামনুর কেন্দ্রে শক্ত করে বেঁধে রাখে দুটি নিউট্রন। সে না হয় বোঝা গেলো, কিন্তু এ নিউক্লিও সংযোজন হয় কেমন করে?.. তারাদের কেন্দ্রকের মধ্যে মহাকর্ষ ও তো কাজ করে কিনা!

তারাদের হেঁশেলে হাইড্রোজেন পরমাণুগুলো প্রবল বেগে ছোটাছুটি শুরু করে, তাদের ভেতরে বিরাজমান মহাকর্ষ বলের জন্যে। তার ফলে নিজেদের মধ্যে অবিরত ঠোকাঠুকি হতে থাকে। এই ঠোকাঠুকির এক পর্যায়ে, যখন হাইড্রোজেন পারমাণুর বেগ একটি নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করে, তখন জোরপূর্বক একটি হাইড্রোজেন পরমাণু, অপর একটি হাইড্রোজেন পরমাণুর কেন্দ্রে ঢুকে পড়ে। এভাবে একে একে চারটি হাইড্রোজেন পরমাণুর সংযুক্তির মাধ্যমে জন্ম নেয় একটি হিলিয়াম পরমাণু। আর বাদবাকি দুটি প্রোটন রূপান্তরিত হয় নিউট্রনে। সাধারণত হিলিয়াম পরমাণুর কেন্দ্রকের ভর দুটি নিউট্রন ও দুটি প্রোটনের সম্মিলিত ভর, থেকে ০.০০৭ ভাগ কম। প্রোটন ও নিউট্রন সহযোগে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস তৈরি হওয়ার সময় যেটুকু ভরের হেরফের হয়, পদার্থ বিজ্ঞানের পরিভাষায় তাকে বলে ‘ভর ত্রুটি’ বা ‘মাস ডিফেক্ট’। আইনস্টাইন এর ‘ভর-শক্তির’ তুল্যতা অনুসারে এই বাড়তি ভর রুপান্তরিত হয় শক্তিতে। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার পোশাকি নাম ‘নিউক্লিও সংযোজন’।এবং সব নক্ষত্রদের মত আমাদের সূর্যের ও হেঁশেলের প্রয়োজনীয় জ্বালানি আসে এখান থেকেই। প্রতিক্ষণে সূর্য থেকে কি পরিমাণ শক্তি নির্গত হচ্ছে জানো? প্রতিমুহুর্তে, প্রায় ৪০,০০,০০০ টনের মতো হাইড্রোজেন বিকিরণের আকারে নিঃশেষিত হচ্ছে । সেজন্যেই সূর্যিমামার এতো তেজ ও তীব্রতা।

নিউক্লিয় সংযোজনের ফলে এই যে হিলিয়াম তৈরী হলো, তা ধীরে ধীরে জমা হয় তারাদের কেন্দ্রে। হিলিয়াম পরমাণুর ভর হাইড্রোজেনের তুলনায় বেশী হওয়ায়, ধীরে ধীরে ভারী হতে থাকে নক্ষত্রের কেন্দ্রক। এই বাড়তি ভরের দরুণ বেশি পরিমান তাপ শক্তি তৈরী হয় তারাদের অন্দরে। এই তাপ বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে, নক্ষত্রের চাপ ও তাপমাত্রা যখন একটি সীমাস্থ মানে পৌছায়, হিলিয়াম পরমাণুদের ভিতর তখন শুরু হয় ‘নিউক্লিয়ার ফিউশন’। এই নিউক্লিও সংশ্লেষনের বিভিন্ন পর্যায়ে একে একে তৈরী হয় কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, জীবনের জন্যে প্রয়োজনীয় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান- আর এই প্রক্রিয়াকেই বলে সি এন ও সাইকেল। মনে পড়ে যায় বিখ্যাত বিজ্ঞানী কার্ল সাগানের সেই উক্তি -” আমাদের ডিএনএতে নাইট্রোজেন, আমাদের দাঁতে ক্যালসিয়াম, আমাদের রক্তে লোহা, আমাদের আপেলের পাইয়ের কার্বনগুলি ভেঙে যাওয়া তারাগুলির অভ্যন্তরে তৈরি হয়েছিল। আমরা তারার অংশ বিশেষ”!
সৃষ্টির শুরুতে, অর্থাৎ মহাবিস্ফোরণের পর তারাগুলিতে হাইড্রোজেন , হিলিয়াম অপেক্ষা ভারী মৌল বিশেষ ছিল না, এদেরকে বলা হয় প্রথম প্রজন্মের নক্ষত্র। এরা আকারেও ছিল বিরাট। ফলে জীবনকাল ছিল কম। সময়ের সাথে এরা বিস্ফোরণের পর এদের ধ্বংসাবশেষ থেকে নতুন নতুন নক্ষত্রদের জন্ম হয়, যাদের মধ্যে আবার লোহা ও অন্যান্য ভারী পরমানুর নিউক্লিয়াস ছিল। বিজ্ঞানীরা এদের নাম দেন দ্বিতীয় প্রজন্মের নক্ষত্র।

এইসব ধ্বংসাবশেষ বা আন্তঃনাক্ষত্রিক ধূলিকণা থেকেও হিসাব করা যায় মহাবিশ্বের বয়স। আবার অনেকগুলো তারা যখন কাছাকাছি অবস্থান করে, দূর দেখলে কেমন যেন পাড়ার মত মনে হয়- তারাদের পাড়া, যাদেরকে বিজ্ঞানীরা ডাকেন গ্লোবুলার ক্লাস্টার নামে। এদের ভেতর মাধ্যাকর্ষণ অত্যন্ত শক্তিশালী। অধিকাংশ গ্যালাক্সিতেই এদের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। এরা মহাবিশ্বের প্রাচীনতম নক্ষত্রগুলো ধারণ করে। এই গ্লোবুলার ক্লাস্টারের তথ্য বিশ্লেষণ করেও জানা যায় মহাবিশ্বের বয়স। এই দ্বিতীয় পদ্ধতি অনুসারে বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন এই সব ক্লাস্টারের নক্ষত্রের বয়স এগার থেকে চৌদ্দ বিলিয়ন বছরের মধ্যে। ২০০০ সালের আগে বিজ্ঞানীদের অনুমান ছিল মহাবিশ্বের বয়স ৭ থেকে ২০ বিলিয়নের ভেতরে।আজকের দিনে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে জ্যোতির্বিদরা হিসেবে করে দেখেছেন মহাবিশ্বের বয়স কিছু কম বেশী ১৩.৭ বিলিয়ন বছর।

…………………………………………………………………………………………………………………………………………….

 

লেখক পরিচিতি: শামীম হক মণ্ডল, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিচার সহায়ক বিজ্ঞান পরীক্ষাগারের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে কর্মরত এবং আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের গবেষক। ভালোবাসেন মাতৃ ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার কথা বুনতে । যোগাযোগ: shamimmondal709@gmail.com
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
1. Astrophysics for people in a hurry by Niel de Grase Tyson
2. The first three minutes… Steven Wienberg.
ছবি স্বীকার:Fig.1: Getty Image
          Fig.2: Wikipedia
          Fig.3: ESA/Hubble & NASA, R. Cohen

Spread the love

Leave a Comment