Posted on: March 29, 2024 Posted by: Editor Desk Comments: 0
Spread the love

এই যে মহাবিশ্ব সময়ের সাথে সাথে বেড়ে চলেছে, তো এর গতি কত? মানে সেকেন্ডে কতটা করে ফুলে ফেঁপে মোটা হচ্ছে মহাবিশ্বের পেট? আর আদি কাল থেকে যে মহাবিশ্বের কথা শুনে আসছে মানুষ, তার বয়স কত? এর কি কোনো সীমা আছে? এই সমস্ত অদ্ভুত প্রশ্ন আলোচনা হচ্ছিল বিজ্ঞানের এক সেমিনারে, আজ থেকে ৯৫ বছর আগে। বক্তা, বিশিষ্ঠ মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল। অনেক দিন ধরেই তিনি মহাবিশ্ব নিয়ে গবেষনা করছিলেন। তখন সদ্য সদ্য মেপেছেন মহাবিশ্বের বয়স, এর সম্প্রসারণের গতি, প্রভৃতি। হলভর্তি দর্শকের সামনে হাবল প্রমাণ করেন আমাদের চেনা শাশ্বত মহাবিশ্ব আর আগের মতো চিরন্তন নয়, এ সতত পরিবর্তনশীল! উপস্থিত দর্শকদের মাঝে হইহই রব পড়ে যায়। এই তরুণ বিজ্ঞানীকে অভিবাদন জানাতে সকলে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন।

মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা আবিষ্কার অনেক দিন হয়ে গেছে ( প্রায় ১৪ বছর) ততদিনে। এদিকে, ১৯২২ সালে আর এক মহারথী, আলেক্সান্ডার ফ্রিডম্যান দেখান যে আইনস্টাইনের সমীকরণকে সমাধান করার সময় আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। সে সময় অধিকাংশ দিকপালরা একথা মানতে চাননি, এমনকি আইনস্টাইন নিজেও সেটা স্বীকার করতে নারাজ ছিলেন। আমাদের চিরচারিত এই মহাবিশ্ব পরিবর্তনশীল হয়ে যাবে? এই ভয় থেকেই তাঁর সমীকরণে একটা নতুন ধ্রুবক জুড়ে দিলেন, আইনস্টাইন – যার নাম মহাজাগতিক ধ্রুবক। যদিও পরে তিনি স্বীকার করেছিলেন এটা তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভূল।


কি করে মাপলেন হাবল মহাবিশ্বের বয়স? ধরো, তুমি রাস্তায় দাড়িয়ে আছো বন্ধুর সাথে দেখা করবে বলে। এমন সময় দেখলে একটা অ্যাম্বুলেন্স লাল বাতি জ্বালিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেলো। অ্যাম্বুলেন্সটি যখন তোমার দিকে আসছিল তখন তার হুইসেলের আওয়াজ, আর যখন বেরিয়ে গেলো, তখনকার হুইসেলের আওয়াজ কি কানে একই রকম ঠেকে? একটু হেরফের হয় না! এই ঘটনাকেই পদার্থবিদ্যার ভাষায় বলে ‘ডপলার এফেক্ট’। এ ঘটনা শুধু শব্দ তরঙ্গ নয়, আলোর ক্ষেত্রেও দেখতে পাওয়া যায়।

ধরো, একটি আলোক উৎস তোমার দিকে ছুটে আসছে , তখন তুমি তাকে তার আসল রঙের থেকে কিছুটা নীলাভ দেখতে পাবে, বিজ্ঞানীরা যার নাম দেন ‘নীল সরণ’ বা Blue shift, আবার আলোক উৎস যদি তোমার থেকে দূরে চলে যেতে থাকে, তবে তুমি তাকে লালচে দেখবে, যাকে পদার্থবিজ্ঞানীরা ‘ লাল সরণ’ বা Red shift নামে চেনে। তোমার আর অলোক উৎসের ভেতরে আপেক্ষিক বেগের হেরফের যতবেশী হবে ততই তুমি এই লাল – নীল খেলা দেখতে পাবে। কি মজাদার ব্যপার না! হ্যাঁ এই মজাদার রঙের পার্থক্য থেকেই গতির হিসেব করা যায়। আর হাবল এই কাজটাই করেছিলেন আমেরিকার মাউন্ট উইলসন মানমন্দিরে। তিনি অনেক বছর ধরে টেলিস্কোপ দিয়ে রাতের আকাশ পর্যবেক্ষন করে আসছেন। পর্যবেক্ষণের সময়, প্রায়শই খেয়াল করেন, দূরের ছায়াপথ গুলো কাছের ছায়াপথের থেকে বেশী লালচে দেখাচ্ছে। শুধু তাই নয়, যে ছায়াপথ যতদূরে, সে তত লালচে!

আমাদের থেকে যে ছায়াপথ যত দূরে, সে তত দ্রুত পালাচ্ছে- অদ্ভুত! আর এই ব্যাপারটিকে হাবল একটা নিয়ম আকারে প্রকাশ করলেন, যা হাবলের সূত্র নামে পরিচিত। আগের দিনেই তোমরা তা জেনেছ। অনেক অঙ্ক কষে হাবল একটা সোজা সূত্র দেন, V= Hd, যেখানে d হচ্ছে দুটি ছায়াপথের ভিতরকার দূরত্ব, V হলো তাদের দূরে চলে যাওয়ার বেগ, এবং H একটি ধ্রুবক, হাবলের সম্মানে তার নাম রাখা হয়, হাবল ধ্রুবক। যারা এখন একটু উচু ক্লাসে উঠেছ, তারা জানো হাবলের সমীকরণকে লেখচিত্রে আঁকলে একটা সরলরেখা পাবে- সেখান থেকে তোমরা সহজেই বার করে ফেলতে পারবে এই সরলরেখার নতি H, হাবল ধ্রুবক। এই H ই হচ্ছে মহাবিশ্বের বয়স বের করার প্রধান চাবিকাঠি। হাবল, এখান থেকেই বার করেছিলেন মহাবিশ্বের বয়স।

আমরা জানি এই মহাবিশ্ব শুরু হয়েছে এক বিস্ফোরণ বা বিগ-ব্যাং এর মধ্যে দিয়ে। সৃষ্টির শুরুতে সব ছায়াপথ একসাথে মিলে মিশে ছিল। বিস্ফোরণের পর এরা একে অপর থেকে ছিটকে দূরে চলে যায়। মহাবিশ্ব যেহেতু সম্প্রসারণশীল, ফলে তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। দৃষ্টির পর থেকে, দুরত্ব বাড়তে বাড়তে ধরো আজ হয়েছে d, আবার মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের বেগ যদি v হয়, এবং T যদি মহাবিশ্বের বয়স হয়, তবে T=d/v, ওদিকে হাবলের সমীকরণের সাথে তুলনা করলে পাওয়া যায়, মহাবিশ্বের বয়স, T=1/H. বিজ্ঞানীরা অনেক হিসেব করে দেখেছেন, আমাদের এই মহাবিশ্ব ১৩.৮ বিলিয়ন বছরের পুরানো। হাবলের শেখানো পদ্ধতি ছাড়াও অন্যভাবেও বার করা যায় মহাবিশ্বের বয়স। সে গল্প আর একদিন হবে।

…………………………………………………………………………………………….

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: 1. Astrophysics for people in a hurry by Niel de Grase Tyson
2. অপূর্ব এই মহাবিশ্ব, এ এম হারুন অর রশীদ, ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী।

লেখক পরিচিতি: শামীম হক মণ্ডল, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিচার সহায়ক বিজ্ঞান পরীক্ষাগারের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে কর্মরত এবং আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের গবেষক। ভালোবাসেন মাতৃ ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার কথা বুনতে । যোগাযোগ: shamimmondal709@gmail.com

……………………………………………………………………………………………….

 

জ্যোতির্বিজ্ঞানের খোঁজ খবর – পর্ব ১


Spread the love

Leave a Comment