
এমন একজনকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে কখনো রাতের আকাশ দেখে বিস্মিত হয়নি। হরেকরকম তারায় ভরা নীল সামিয়ানা। খালি রাতেই নয়, দিনের বেলায় ও আকাশে থাকে ওরা। কেবল ঢাকা পড়ে যায় এক নক্ষত্রের আলোয়- সে আমাদের চেনা পরিচিত সূর্য। মনে পড়ে কবি গুরুর সেই বিখ্যাত লাইন-
“রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে”।
সূর্য কিন্ত ওই মিটমিট করা তারাদের থেকে আকারে অনেক ছোট, কিন্ত যেহেতু আমাদের অনেক কাছে আছে, সেজন্য গোল থালার মত বড়ো মনে হয়।
ছেলে বেলায় মনে হতো ওরা কত দূরে ? উড়োজাহাজে করে ওদের কাছে পৌঁছানো যাবে? কতদিন সময় লাগবে? পূর্ণিমার দিন গুলোতে আবার চাঁদকে বেশী আপন লাগত – মনে হতো যদি একবার চাঁদে যাওয়া যায়! তার আর একটা কারণ অবশ্য আছে – বাড়ির গুরুজনরা এতো চাঁদের গল্প বলতেন! সময়ের পাল্লায় ভর করে চাঁদে পৌঁছল মানুষ, আমাদের দেশের বিজ্ঞানীদের পাঠানো মহাকাশযানও পৌছেছে চাঁদে সফলভাবে। বড় হওয়ার সাথে সাথে জেনেছি তারারা আমাদের থেকে অনেক দূরে আছে – কয়েক লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ দূরে! আলোকবর্ষ আবার কি? কেনো এক বছরে আলো যত দূরত্ব অতিক্রম করে।
যে তারাগুলোকে আমরা রাতের আকাশে দেখতে পাই – তার সংখ্যা কত বলোতো? হাজার, লক্ষ? না তারও বেশী! সব চেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে আমাদের দৃশ্যমান তারার চেয়ে এমন তারার সংখ্যাই বেশী, যাদেরকে আমরা এখনো দেখতে পাইনি। কবে পাবো তাও জানিনা। কি একটু আশ্চর্য লাগছে? তবে শোনো, কীভাবে তারাদের দেখি আমরা? ওদের থেকে আলো আমাদের কাছে এসে পৌছানোর পর। ওইসব তারারা এতো দূরে আছে, যে ওদের থেকে পৃথিবীতে এখনো আলো এসে পৌছতে পারেনি। ভাবো কান্ড! আলো কিন্ত অনেক জোরে ছোটে – সেকেন্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার। আলোকবর্ষের হিসাবে, আলো এক বছরে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল যেতে পারে। তাহলে ভাবো কত দূরে ওইসব নক্ষত্রেরা। এদের মাঝে অনেক গুলো হয়তো মারা গেছে এতদিনে, আর তাদের ঝিকিমিকি হাসি ধেয়ে আসছে আমদের দিকে।
এই তারাগুলো মহাকাশে আবার একা ত্থাকেনা – নিজেরা দল বেঁধে একটা সভা সমিতি গড়ে থাকে – জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা যাদের নাম দিয়েছেন ‘তারার দল’ বা ‘ক্লাস্টার’। আর এইরকম অনেক গুলো তারার দল মিলে মিশে যে অঞ্চলে থাকে, তাকে আমরা বলি গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ। এদের আবার বেশ গালভারী নাম আছে – যেমন আকাশ গঙ্গা, অ্যান্ড্রমিডা গ্যালাক্সি, প্রভৃতি। আমাদের সূর্য যেমন আকাশগঙ্গা ছায়াপথের সদস্য।
তারাকে কেন্দ্র করে গ্রহগুলি ঘুরপাক খাচ্ছে নির্দিষ্ট কক্ষপথে। কোনো কোনো গ্রহ গুলিকে কেন্দ্র করে আবার আর একটা বস্তু ঘুরপাক খাচ্ছে, যাকে বলে উপগ্রহ- যেমন আমাদের চাঁদ। বৃহস্পতির, শনির আবার অনেকগুলো করে চাঁদ আছে।
ছায়াপথে এরকম নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহানুপুঞ্জ আরো কতকি যে থাকে? এরকম অজস্র ছায়াপথ নিয়েই আমাদের এই বিরাট মহাবিশ্ব। বিজ্ঞানীদের অনুমান, দৃশ্যমান এই মহাবিশ্বে ছায়াপথের সংখ্যা কমবেশী দশ হাজার কোটি! অর্থাৎ একের পিঠে এগারটা শুন্য। ধরো কোনো মানমন্দিরে সেকেন্ডে যদি একটা করে ছায়াপথ ও গণনা করা যায়, তাও সময় লাগবে প্রায় ৭৬ হাজার বছর!
বিজ্ঞানীরা মনে করেন প্রতিমুহুর্তে এই মহাবিশ্বের আয়তন বেড়েই চলেছে। অর্থাৎ মহাবিশ্ব সম্প্রসারণ শীল। ফলে এর মধ্যে ফাঁক স্থান ক্রমশ বাড়ছে। একটু আগে যে বিভিন্ন ছায়াপথের কথা বলছিলাম, তাদের ভিতরে দুরত্ব বাড়ছে প্রতিনিয়ত। সুদীর্ঘ নবছর গবেষনার পর ১৯২৯ সালে, হাবল এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে ” ছায়াপথ গুলি একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে – আর যার দূরত্ব যত বেশী, তার পরস্পর থেকে দূরে যাওয়ার বেগ ও তত বেশি”। এটিই হাবলসের সুত্র নামে পরিচিত। কেমন একটা খটকা লাগলো না কথাটা শুনে? একটা সোজা পরীক্ষার দ্বারা এর ব্যখ্যা করা যায় – একটা বেলুন নাও। তার উপরে লাল মার্কার পেন দিয়ে কাছাকাছি দুটো বিন্দু আঁকো। আর একটা নীল মার্কার দিয়ে একটু দূরে দুটি বিন্দু আঁকো। এবারে ফু দিয়ে ফোলাতে থাকো – দেখতে পাবে নীল বিন্দু দুটির মধ্যে দুরত্ব বাড়ছে দ্রুত। তার মানে এই মহাবিশ্বে দূরে দূরে থাকা গ্যালাক্সি গুলো পরস্পর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে, সেই সাথে তাদের পেটের ভিতরে থাকা তারা গুলোও দূরে সরে যাচ্ছে – প্রতিনিয়ত। মনে পড়ে মহীনের ঘোড়াগুলির সেই বিখ্যাত গান – “তারারা সব আলোক বর্ষ দূরে… যায় ক্রমে সরে সরে.”।
ক্রমশঃ
লেখক পরিচিতি: শামীম হক মণ্ডল, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিচার সহায়ক বিজ্ঞান পরীক্ষাগারের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে কর্মরত এবং আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিউক্লিয়ার অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের গবেষক। ভালোবাসেন মাতৃ ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার কথা বুনতে । যোগাযোগ: shamimmondal709@gmail.com
খুব ভালো লেখা। গ্যালাক্সিগুলো দূরে সরে যাওয়ার উদাহরণটা ছাত্র ছাত্রীদের বোঝাতে খুবই সুবিধা হবে।