Posted on: February 12, 2024 Posted by: Editor Desk Comments: 0
Spread the love

৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪। আজ ‘প্রভু’র সংবাদ পত্র ‘এই সময়’ প্রথম পাতায় খবর করেছে, “প্রায় মহামারীর আকার নিচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স। মামুলি সংক্রমণেও কাজে আসছে না মহার্ঘ অ্যান্টিবায়োটিক। মুড়ি-মুড়কির মতো অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারে আর ওষুধে বাগ মানছে না ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ। যথেচ্ছাচার রুখতে তাই কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারি তরফে অ্যান্টিবায়োটিক লিখলে প্রেসক্রিপশনে তার কারণ উল্লেখ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সম্প্রতি চিকিৎসকদের। কিন্তু বিশেষজ্ঞ মহলের একাংশ সংশয়ী, তাতে আদৌ কতটা কাজ হবে? আজ শেষ কিস্তি।” এবং আরো লিখেছে, “রাশ টানার ক্ষেত্রে কোয়াকরা বড় অন্তরায়।'(এই সময়)।
খবর পড়তে পড়তে গোর্কির শিক্ষামালা চোখের সামনে উদ্ভাসিত হলো। তা তুলে ধরছি —
“প্রভুর জীবন সম্পর্কে ভৃত্যের মুখ হইতে খোলাখুলি শুনিবার মতোই বুর্জোয়া সংবাদপত্র পড়া কাজে লাগে বলিয়া আমি মনে করি ।”(ম্যাক্সিম গোর্কি । নানা লেখা)।
এ খবর ‘প্রভু’র স্বার্থ রক্ষা ! ‘প্রভু’র কথামত !
ওঁরা কী সত্যি ‘এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু’দের নিয়ে চিন্তিত ? না। ওঁরা কী সত্যি সত্যি জনমানুষের রোগে জীবাণু সংক্রমণকে রুখতে বা প্রতিরোধ করতে চায় ? না। সামগ্রিক ভাবে জনমানুষের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে ওঁরা কী আদৌ দায়িত্বশীল ? আদৌ না।
তাহলে সংবাদ মাধ্যমে ‘প্রভু’র ‘ভৃত্য’রা চীৎকার করছে কেন? এ প্রশ্নে কমরেড লেনিনের মহান শিক্ষামালা আমাদের দিশা দেয়।
“যে কোনো নৈতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক বচন, ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতির পেছনে কোনো না কোনো শ্রেণীর স্বার্থ আবিষ্কার করতে না শেখা পর্যন্ত, লোকে রাজনীতির ক্ষেত্রে চিরকাল প্রতারণা ও আত্মপ্রতারণার নির্বোধ বলি হয়েছিল এবং চিরকাল তা থাকবেই ।”(লেনিন । মার্ক্সবাদের তিন উৎস ও উপাদান)।


দেশের অপাসকরা ও বেআইনী চিকিৎসকদের(ওঁদের সংস্কৃতি ও ভাষায় “কোয়াক” –লেখক) সম্পূর্ণ দায়ী করে ওঁরা বোঝাতে চায়, এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স “কোয়াক”দের জন্যই ঘটে চলেছে। অতএব সাধু সাবধান !
পশ্চিমবঙ্গের ‘বেআইনী চিকিৎসা বাজারে’ কমবেশী দুই লক্ষ অপাসকরা-বেআইনী চিকিৎসক কাজ করছেন। এঁরা গ্রামাঞ্চলের কমবেশী সত্তর শতাংশ(৭০%) মানুষের চিকিৎসা পরিষেবা দিয়ে থাকেন।
আমরা যদি ভারতবর্ষের এই অপাসকরা ও বেআইনী চিকিৎসকদের সৃষ্টি, বিকাশ ও এগিয়ে চলার ইতিহাস গবেষণা করি তাহলে দেখবো, দেশের শাসকশ্রেণী পরিচালিত অবৈজ্ঞানিক জনবিরোধী ব্যবস্থাপনা এঁদের ‘অবৈধ’ ভাবে জন্ম দিয়েছে। ‘অবৈধ সন্তানে’র মতো ‘পিতা'(রাষ্ট্র ও সরকার) সব গোপন করেছে !
এই ‘অবৈধ সন্তান’দের দায়ভার সরকারকে গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু সরকার বিগত ছিয়াত্তর(৭৬)বছর ধরে এঁদের চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রশিক্ষণ না দিয়ে, প্রয়োগ দক্ষতা না বাড়িয়ে, “কোয়াক” বলে অসম্মান, অপমান, ঘৃণা ও বঞ্চনা করছে। উচ্ছেদের অপচেষ্টা চালাচ্ছে(এনএমসি আইন -২০১৯)। এক পেশে ভাবে, অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক ও শ্রেণী-স্বার্থে, এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের জন্য একমাত্র “কোয়াক”দের দায়ী করছে।
দুই “বৈশ্যের ক্রীতদাস”
যে কোন বিজ্ঞান চর্চা ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে একদেশদর্শীতা (‘কোয়াক অন্তরায়’–লেখক) সত্য সন্ধানে বাধা সৃষ্টি করে। এতে সত্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়।
আর বিজ্ঞানীদের মনোভাব যদি ঘৃণ্য শ্রেণী-স্বার্থে জারিত হয়, তাহলে তো পরিবেশে দুর্গন্ধ ছড়াবেই ! পুঁজিবাদের গলিত শবের দুর্গন্ধ!
এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের প্রশ্নে একবার দেখে নেওয়া যাক, দু’জন ‘বৈশ্যের ক্রীতদাস’ চিকিৎসকের কী মতামত।
“রাজ্যের অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কমিটির কর্তা, এসএসকেএমের জেনারেল সার্জারি বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র সরকারও মানছেন, ‘শুধু ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশনে অ্যান্টিবায়োটিক লেখার কারণ দর্শানো বাধ্যতামূলক করলেই হবে না। দরকার আইনি কড়াকড়ি। ওষুধের দোকানদার যাতে কোনও ভাবেই এমবিবিএস পাশ চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করতে না পারেন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।’ তাঁর মতে, এর জন্য শুধু দোকানিদের সচেতন করে লাভ নেই। কড়া আইনি ব্যবস্থা প্রয়োজন।”(এই সময়)।
এরপর আমেরিকার হাভার্ড, ম্যাসাচুসেটস ও বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানীর ‘প্রশংসিত ও সম্মানিত’ (‘আপন সন্তান’– লেখক) ডা.অভিজিৎ চৌধুরীর বক্তব্য তুলে ধরছি।


“যদিও বিশিষ্ট হেপাটোলজিস্ট অভিজিৎ চৌধুরী মনে করছেন, ‘চিকিৎসকরা নতুন অ্যান্টিবায়োটিক প্রোটোকল মানলে, তার সুফল কোয়াকদের ক্ষেত্রেও দেখা যাবে। কারণ, কোয়াকরা শহরের ডাক্তারবাবুদের প্রেসক্রিপশনই অনুসরণ করেন।”(এই সময়)।
একদেশদর্শীতার পর্যবেক্ষণ
এক অবৈজ্ঞানিক মূল্যায়ণ
ভারতবর্ষের এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধের কারণ অনুসন্ধানে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে   :

(১) ভারতে ব্যাপক জনমানুষের অপুষ্টি। যা মানবদেহের যে কোন প্রতিরোধে অন্তরায় হয়। ভারতের কুড়ি শতাংশ মানুষ রাতের খাবার না খেয়ে বা পাকস্থলীর যন্ত্রণা নিয়ে ঘুমাতে যান। ভারতে প্রতি বছর আঠারো লক্ষ মানুষ অনাহারে মৃত্যুকে মেনে নিতে বাধ্য হোন।
শারীরিক অপুষ্টি, ক্ষুধার যন্ত্রণা, অনাহার ও রোগ-ভোগ কী এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স এ প্রভাব ফেলে না ? অবশ্যই ফেলে । এই সব বিষয়কে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স সম্পর্কহীন করা কাদের স্বার্থে ? জনস্বার্থে যে নয় তা সহজেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।
(২) আজকের যুগে সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশী এন্টিবায়োটিক ব্যবহার হয় পশু ও মুরগী পালনে। শুয়োরের বৃদ্ধি বা ওজন বাড়ানোর জন্য ডক্সিসাইক্লিনের(Doxycycline) ব্যবহার, যে কোন এমবিবিএস ছাত্রের জানার কথা ! বিশ্বে পাসকরা পশু চিকিৎসকদের চেয়ে ‘অপাসকরা পশু ডাক্তার’রা বেশী এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করেন। মানুষের চেয়ে পশুপালনে অনেক বেশী এন্টিবায়োটিক ব্যবহার হয়।
(৩) কৃষি, ফুল চাষ, মাছ চাষ, মৌমাছি পালন, টিনজাত খাবার সংরক্ষণ ইত্যাদিতে ব্যাপক এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। যা খাবার বা ফেলে দেওয়ার মাধ্যমে পরিবেশের মাটি ও জলে মেশে। মাটি ও জলের মিশ্রিত এন্টিবায়োটিক আবার খাবার ও পানীয় জলের মাধ্যমে মানব শরীরে ঢোকে। এ সব ঘটনা কী এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স নিয়ে প্রকৃতিতে হাজির হয় না ? অবশ্যই হয়।

(৪) আজ আমরা অনেকেই জানি, মানব শরীর ‘জীবাণু সমুদ্রে’ দ্বীপের মত। মানব দেহের কোষ দশটি হলে খাদ্যনালী ও দেহকে ঘিরে জীবাণুদের সংখ্যা নব্বইটি। মানব দেহকে ঘিরে ‘জীবাণু জগৎ বা সমুদ্র’ বিভিন্ন কারণে নিজেদেরকে এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী করে তোলে।
পরিবেশ দূষণ, সানিটাইজার, কসমেটিকস ব্যবহার ও বিভিন্ন রোগে বিভিন্ন ওষুধের ব্যবহার এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স গড়ে তোলে।
(৫) ভারতবর্ষের জনগণের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ কী (গৃহহীন ও ফুটপাতের বসবাসকারী মানুষ, বেকারীত্ব, অবৈজ্ঞানিক লোকাচার ইত্যাদি) মানুষকে ঘিরে জীবাণু জগতে প্রভাব ফেলে না ?, অবশ্যই ফেলে।
জীবাণুদের এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণের বিভিন্ন দিক বা সমগ্রতা বিচার না করে কেবল “কোয়াকমুখী” পর্যবেক্ষণ ও দোষারোপ সমস্যার সমাধান করবে না। বরং সমাজে ঘৃণ্য ক্রীতদাসত্বের ‘বিজ্ঞানচর্চা’ বলে চিহ্নিত হবে।
—-
                                                                         স্বপন জানা।৭ফেব্রুয়ারি ২০২৪। কলকাতা।
                                                                 সৌজন্য : সোসাইটি ফর সোসাল ফার্মাকোলজি।


Spread the love

Leave a Comment