Posted on: June 19, 2025 Posted by: Editor Desk Comments: 0
Spread the love

আদিগঙ্গার দুইপারে জবরদখল উচ্ছেদ শুরু : গ্রামবাংলার নদ-নদীকে তাদের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া যাবে তো ?

তথ্য এক : নরেন্দ্রপুর কামালগাছি থেকে বারুইপুর থানার দক্ষিণ শাসন পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে আদিগঙ্গার দুই পাড় একেবারে জবরদখলকারীদের দখলে চলে গিয়েছে। যত্রতত্র গজিয়ে উঠেছে হরেক কিসিমের দোকানপাট, রেস্তোরা, এমনকি গ্যারেজ, কোথাও আবার সরকারি নির্মাণ। আদিগঙ্গা ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। পাশাপাশি নদীর জলে দূষণ বাড়ছে মাত্রাতিরিক্ত হারে। ১৬ জুন জেসিবি দিয়ে জবরদখলকারীদের এসব অবৈধ কাঠামো ভেঙে ফেলার কাজ শুরু হয় সেচদপ্তর ও বারুইপুর মহকুমা প্রশাসনের তরফে। প্রথম দিন বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে বারুইপুরের পদ্মপুকুর থেকে উত্তরে দেড় কিলোমিটার এলাকা জুড়ে চলে বিশেষ অভিযান। 

এই প্রসঙ্গে সেচদপ্তরের এক আধিকারিক জানিয়েছেন – ১৭ কিলোমিটার বিস্তৃত বাইপাসের আদিগঙ্গার পাড়ে জবরদখল উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা হয়েছে। পুরোপুরি উচ্ছেদের পর বাইপাসে দুই দিকেই লোহার ফেন্সিং করা হবে। তার জন্য এক কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা ধার্য করা হয়েছে। (তথ্যসূত্র : এই সময় পত্রিকা ১৭ জুন, ২০২৫) 

তথ্য দুই : আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খবর চূর্ণী নদীকে দূষণমুক্ত করতে রানাঘাট পৌরসভার উদ্যোগে শহরের নিকাশি জল শোধন করে দুটি পরিশোধনের ইউনিট চালু হয়েছে। এই পরিশোধিত জল চূর্ণীতে ফেলা হবে। রানাঘাট পুরসভা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন করার দায়িত্বে থাকা ‘কলকাতা মিনিসিপাল ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’র সূত্রে জানা গিয়েছে রানাঘাট শহরে আরও দুইটি ইউনিট গড়ে তোলার কথা ভাবা হচ্ছে। (তথ্যসূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা ১৫ই জুন,২০২৫) ।

আমাদের কথা :

দূষণ জর্জরিত চূর্ণী নদীকে বাঁচাতে হলে শুধুমাত্র রানাঘাট শহরে দুটি বা চারটি জলশোধন প্রকল্প চালু করলেই হবে না। চূর্ণী, জলঙ্গি, অঞ্জনা, সোনাই নদীতে নানান শহরের নিকাশী নালার জল এবং আবর্জনা গিয়ে মেশে। নদীগুলোর জল অনেক জায়গাতেই বিষাক্ত কালো। এইসব নদীর জল আজ খাওয়া তো দূরের কথা, এখন এই নদীগুলোতে হাত-পা ধোয়াও ভয়ংকর বিপদের কারণ হয়ে উঠেছে। অথচ এইসব নদীগুলি ছিল গ্রামবাংলার অসংখ্য মৎস্যজীবীদের জীবিকার উৎস, চাষের কাজে জলসেচের প্রধান সহায়, গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার, এমনকি এইসব নদীর জল একসময় পানীয় জল হিসাবে ব্যবহার করতেন অঞ্চলের অসংখ্য মানুষজন। ইতিহাস বলে, এইসব নদীগুলির প্রায় সবকটির উপর দিয়েই বড় নৌকো বা জাহাজ চলাচল করতো পণ্যসামগ্রী নিয়ে। কিন্তু সে সবই আজ অতীত। একসময়ের প্রাণোচ্ছ্বল, দুই পাড় উপচে কুলকুল করে বয়ে যাওয়া নদীগুলোর অধিকাংশ জায়গাতেই আজ হেঁটে পার হওয়া যায়।

আদিগঙ্গার দুইপারের কয়েকশো অবৈধ নির্মাণ ভেঙে ফেললে শত শত পরিবারের রুটিরুজির অসুবিধা হবে ঠিকই। কিন্তু আদিগঙ্গা, জলঙ্গি, চূর্ণী, সরস্বতী সহ মজে যাওয়া দূষণ জর্জরিত নদনদী গুলোকে তথা প্রকৃতি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে সরকার প্রশাসনের এই ধরনের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু এত দেরি করে শুভবুদ্ধির উদয় হল কেন? অনেক আগেই এই কাজে হাত দেওয়ার দরকার ছিল। শুধু আদিগঙ্গা কেন, আজ গ্রামবাংলার প্রায় সব নদীর দুই পাড় নানান ধরনের অবৈধ নির্মাণ, বালি মাফিয়া, ইটভাটার দৌরাত্বে এবং প্রবল দূষণের কবলে সেগুলো মৃতপ্রায়। 

সুতরাং গ্রাম বাংলার সমস্ত নদনদীর অবিরল প্রবাহে অবরোধ মুক্ত করতে এবং দূষণের হাত থেকে বাঁচাতে হলে জবরদখল উচ্ছেদ যেমন প্রয়োজন, প্রয়োজন সামগ্রিক পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে এদের সংস্কার করা। দরকার নদীর দূষণ কমাতে শহরের নিকাশীনালার জল পরিশোধন করে নদীতে ফেলা। পাশাপাশি নদীতে শহরে সব ধরনের বর্জ্য ফেলার যে প্রতিযোগিতা চলছে, তা বন্ধ করতে হবে অবিলম্বে। তার জন্য দরকার সেচদপ্তর, পৌরসভা বা পঞ্চায়েত, প্রশাসন, নদী বিশেষজ্ঞ, পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী এবং স্থানীয় মানুষ সহ সমস্ত স্তরের এক সামগ্রিক ও বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা এবং যথাসময়ে তার রূপায়ণ। এর পাশাপাশি এটাও স্পষ্ট করেই বুঝে নিতে হবে, সমস্ত ছোট নদী, নালা, খালবিল গুলো পরিপুষ্ট হয় গঙ্গা, দামোদর, দারেকশ্বর, কংসাবতী, ইছামতি, পদ্মার মতো বড় নদীগুলোর জলের ধারার উপর নির্ভর করেই। অথচ অজস্র জলাধার বা বাঁধ নির্মাণের অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক পরিকল্পনার ফলে এইসব নদীগুলো আজ আর অবিরল ধারায় বইতে পারছে না। সেগুলোও আজ দূষণ জর্জরিত।

তাই সমগ্র নদী ব্যবস্থাকে অবিরল ধারায় নির্মল ভাবে বইতে দেওয়ার কাজ করতে হলে ছোট নদীগুলোকে সংস্কার করার পাশাপাশি উৎস মুখের বড় নদীগুলোকে বাঁচাতেই হবে যেকোন মূল্যে। 

সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ছোট বড় সমস্ত নদ নদীগুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে হবে। নাহলে প্রকৃতি পরিবেশের ভারসাম্য ও নদী বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি, শেষ বিচারে অসংখ্য মানুষের জীবন-যাপন, ভাষা সংস্কৃতি ও জীবিকার ক্ষেত্রে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে নিঃসন্দেহেই। মনে রাখতে হবে, মানুষের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ককে পুনরুদ্ধার করতে হবে। প্রকৃতির সন্তান মানুষকে অনেক বেশি করে প্রকৃতি মুখীণ হতে হবে। অর্থনৈতিক লাভ ক্ষতির ক্ষুদ্র গন্ডির বাইরে বেরিয়ে প্রকৃতি কেন্দ্রিক ভাবনায় জারিত হতে হবে। প্রকৃতির সব উপাদানকে দখল করা যায়না। সব স্থানে মানুষের পা না রাখাই দরকার নিজেদের বেঁচে থাকা ও পরবর্তী প্রজন্মকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে।

 লেখক : সন্তোষ সেন, শিক্ষক ও বিজ্ঞান লেখক 


Spread the love

Leave a Comment