
মানসসমীক্ষা
আকাশবাণী কলকাতা, ৩ জুন ২০২৫ :
‘আমার অত্যন্ত প্রিয় এই যে জিনিসটা’, বলে বুকপকেট থেকে কালো রঙের কলমটা বের করে টেবিলের উপর রাখলেন ভদ্রলোক। ‘আমি চাই যে এই পেনটা বহু দিন ধরে আমার কাছে থাকুক, অক্ষয় হয়ে থাকুক চিরদিন।’ যুক্তিটা অবহেলা করার কোনো জায়গা নেই। সবাই চাইবেন যে তাঁর পছন্দের, তাঁর ভালোলাগার জিনিসটা অটুট থাকুক আবহাওয়ার সব খামখেয়ালিপনা সয়ে। ভদ্রলোকের কথা শেষ হয় নি তখনও। ‘লোহা দিয়ে তৈরি হলে এতে জং ধরবে, কাঠের হলে রোদে-জলে ক্ষয় হবে, কাঁচের হলে পড়ে ভেঙে যাবে। কিন্তু প্লাস্টিকে তৈরি হলে এসব সমস্যা নেই!’ মোক্ষম বক্তব্য, প্লাস্টিকের এই অক্ষয় সূত্র অস্বীকার করে কার এমন সাধ্য!
ভদ্রলোকের কথায় সমর্থন যোগাতে এরই সঙ্গে যুক্ত হতে পারে প্লাস্টিকের আরও অনেক বৈশিষ্ট্য। অনেক কম খরচে তৈরি করা যায় প্লাস্টিক, উজ্জ্বল এবং বিচিত্র বর্ণের হতে পারে সেগুলো, গঠনে আর নকশায় যেমন টেকসই তেমনি অভিজাত হতে পারে প্লাস্টিকের পণ্য। সপক্ষে কথা আছে আরও। প্রথম যে প্লাস্টিক, উদ্ভাবকের নামেই যেটার নাম পার্কসাইন, সেটা এসে হাতিদের বাঁচিয়েছিল। তার আগে বিলিয়ার্ড খেলার বল, পিয়ানোর রীড তৈরি হত হাতির দাঁত দিয়ে। সেটা ১৮৬২ সালের কথা। ১৯০৭ সালে লিও বেকল্যাণ্ড আনলেন বেকেলাইট। সেটাকে বলা হত হাজার কাজের উপযোগী। ইলেকট্রিকের সুইচ, টেলিফোনের শরীর – কী-ই না তৈরি হত সেটা দিয়ে! সেও তো প্রকৃতির রসদ বাঁচানো হল। বেকেলাইট না থাকলে গাছের দফারফাই তো হত! আরও পঁচিশ বছর পরে এল পলিথিন। এই বোধহয় মনে পড়ছে প্লাস্টিকের দোষের বহর, তাই না? ফিনফিনে প্লাস্টিকের ব্যাগ, তাতে করে শাকসব্জী, মাছ-মাংস, এটা-ওটা। যত অভিযোগের আঙুল সেটার দিকে। পলিথিনের ব্যাগ নেবেন না, বর্জন করুন প্লাস্টিক। সে সব কথায় কান কেউ দেয় নি, প্রশাসনিক আদেশে কেবল সামান্য পুরু হয়েছে ব্যাগের উপাদান। যাই হোক, যেটা বলছিলাম, প্লাস্টিকের উদ্ভাবন কিন্তু থেমে রইল না পলিথিনে। কয়েক বছর পরেই এল নাইলন। আরও কয়েক বছর পরে পেট। না, পাকস্থলী নয় মোটেই। এ হল পলিঈথিলীন টেট্রাপথ্যালেট। নামের ধাক্কায় চোখে সর্ষেফুল দেখলে বলে দিতে হবে যে এ হল সেই পদার্থ যার মধ্যে প্রিয় ঠাণ্ডা পানীয় বা ফলের রস বন্দী অবস্থায় আপনার অপেক্ষা করে।
এই যে আমাদের এবং প্রকৃতির এত উপকারী প্লাস্টিক, তার সম্পর্কে দু’ একটা অন্যরকম তথ্য এবার না দিলেই নয়। চেনা কথাটা আগে বলি – প্লাস্টিক ফেলে দিলে প্রকৃতিতে মেশে না। হাজার-হাজার বছর পড়ে থাকবে, টুকরো-টুকরো হয়ে মিশবে জলে-মাটিতে, অন্যান্য জায়গার সঙ্গে স্থান হবে তৃণভোজী গরু-মোষের খাদ্যনালীতে। ও হ্যাঁ, আমাদের শরীরটাও কিন্তু এর থেকে বাদ নেই। কথা উঠতেই পারে – সে তো পোড়া মাটির তৈরি ভাঁড়ও মেশে না মাটিতে। দোষ কেবল প্লাস্টিকের হবে কেন? একটা তথ্য যথেষ্ট হবে এক্ষেত্রে। প্লাস্টিককে ঠিকঠাক রাখতে তার সঙ্গে মেশাতে হয় গুচ্ছ-গুচ্ছ রাসায়নিক পদার্থ। সমীক্ষা বলছে, ২০১৯ সালে বিশ্বজুড়ে দু’ কোটি টন এমন পদার্থ দরকার হয়েছিল প্লাস্টিকে মেশানোর জন্য। ২০৫০ সালে পরিমাণটা নাকি পৌঁছবে ২০০ কোটি টনে। এই পদার্থগুলোর প্রত্যেকটাই বিষাক্ত। পোড়া মাটি অক্ষত থাকলেও এর অতি সামান্য অংশ বিষও মেশায় না পরিবেশে। অতএব, এই গেল একটা ধন্দের সমাধান। এবার আসবে পুনর্ব্যবহারের উপযোগী করার জন্য প্লাস্টিকের রিসাইক্লিং। সেখানে পরিস্থিতিটা কী দেখা যাক।
সাম্প্রতিক সময়ে আসল সত্য উদ্ঘাটিত হয়েছে এ ব্যাপারে। প্লাস্টিকের রিসাইক্লিং বিষয়টা প্রায় একটা ধাপ্পা ছাড়া কিছু নয়। ‘প্রায়’ বলা হল এই কারণে যে বাতিল প্লাস্টিকের রিসাইক্লিং হয় দশ শতাংশেরও কম। আর যদি হয়ও যৎসামান্য রিসাইক্লিং তাহলে যা তৈরি হয় তা আবর্জনার ঢিবিতে মিশবে অচিরে। সেটা নিয়ে আর কোনো রিসাইক্লিং কিন্তু সম্ভব নয়! ফলে মাটিতে বিষ মেশাকে বড়জোর সামান্য বিলম্বিত করতে পারে রিসাইক্লিং। কিন্তু বাতিল প্লাস্টিক দিয়ে রাস্তা বানানো, ইমারত বানানো – এসব তো আছে, নাকি? খোঁজ নিলে আশার ফানুসটা চুপসে যেতে পারে।
তবু আশাবাদী হওয়া আমাদের কর্তব্য। কিন্তু কে আশা দেবে, কে ভরসা যোগাবে? ‘প্লাস্টিক চাই না’ বলে বিশ্ব পরিবেশ দিবসে স্লোগান তোলে যারা? নাকি প্লাস্টিক বানায় যারা? এই যে দ্বিতীয় গোষ্ঠী, তারা কিন্তু ভারি শক্তিশালী, ভারি ব্যস্ত, আমাদের কথা ভাবার সময় কোথায় তাদের! অনেকেরই খেয়াল থাকে না যে আসলে পেট্রোলিয়াম কোম্পানিরাই প্লাস্টিকের উৎসভূমি। যত তেল তোলা হবে, যত তার প্রসেসিং হবে তত বেরিয়ে আসবে উপজাত যা দিয়ে তৈরি হয় প্লাস্টিক। বাণিজ্যের, মুনাফার এই অংশটা বাতিল করতে যাবে কেন তারা? প্লাস্টিক অতএব থাকছে।
আর আমরা? সেটা বলা ভারি মুশকিল।
লেখক ড. মানস প্রতিম দাস
বিজ্ঞান লেখক ও বিজ্ঞান সম্প্রচারক
আকাশবাণী কলকাতা
[পাঠকের প্রতি বিশেষ অনুরোধ লেখাটি পড়ে অবশ্যই মূল্যবান মতামত কমেন্ট বক্সে দেবেন ।]