
মাঝে মাঝে হঠাৎ করে আলো নিভে যায়। গত বছর এই দিনে ২০ জুলাই ২০২৩, আমার জীবনে, আমাদের অনেকের জীবনে হঠাৎ আলো নিভে গেছিল। সেদিন সমর বাগচী, আমাদের সকলের সমর দা, চলে গেলেন। সমর দা’র কয়েকমাসের গুরুতর অসুখ এবং তাঁর প্রয়াণ সাম্প্রতিক কালের মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনা। সমর দা’র সাথে পরিচয়ের পরে তিনি আমার জীবনে এমন এক বিশেষজন হয়ে উঠেছিলেন, যাঁর সাথে আমি আমার প্রাত্যহিক সুখ, দুঃখ, আনন্দ ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছিল। কি করছি, কি ভাবছি, কি করতে হবে, কোথায় যেতে হবে, এইরকম ইত্যকার সবকিছুর সাথে তিনি জড়িয়ে গিয়েছিলেন। শুধু আমি নই। এরকম আরো অনেকের জীবনে সমর দা হয়ে উঠেছিলেন এক বিশেষ জন। এক আপন জন। যখন চারিদিকে শুধু নৈরাশ্য, অবিশ্বাস, স্থবিরতা, একঘেঁয়েমি, আদৰ্শচ্যুতি সেই সময় সমর দা, এক guiding spirit হয়ে আমার জীবনে এসেছিলেন। তাঁর ফোন নম্বরে একবার ডায়াল করলেই হল। ফোনের ওপারে সদা হাস্যময় মানুষটি সদা উপস্থিত। খুব প্রয়োজনীয় কাজে থাকার সময়েও সমর দা, ফোন ধরতেন।
সমর দা, চলে যাওয়ার পরে আমি লিখেছিলাম ‘ পৃথিবী ও মানুষকে ভালবাসতে শিখিয়েছিলেন সমর দা ‘। একদমই তাই। তাই যিনি বিড়লা সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি মিউজিয়ামের কয়েক দশকের অধিকর্তা, তিনিই স্কুলের ছাত্র, ছাত্রীদের সহজে বিজ্ঞান পড়ানোর জন্যে আসমুদ্রহিমাচল কর্মশালা করেন, তিনিই পরিবেশ আন্দোলনের, গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষার এক সক্রিয় সহযোগী। তিনিই বেশ কিছুকাল একটি বিখ্যাত অনাথ আশ্রমের ট্রাষ্টির প্রেসিডেন্ট।
নব্বই বছর বয়েসে যিনি ঘন্টার পর ঘন্টা বিজ্ঞানী, অধ্যাপক, সমাজকর্মী, পরিবেশ কর্মী, ইতিহাসবিদ, লেখক, কবি, সম্পাদক, সাংবাদিক বিভিন্ন সংগঠনের লোকজনের সাথে কথা বলতেন। তাদের কাজের আপডেট নিতেন। ইমেলেও চলত কথা। সমর দার কম্পিউটর বন্ধ হত না। তাঁর বিশাল কর্মকাণ্ডের আরেকটি বড়ো কাজ ছিল, মানুষে মানুষে সংযোগ ঘটানো। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষে মানুষে সংযোগ হলেই কোনো বড়ো উদ্দেশ্য সফল হতে পারে বিচ্ছিন্নতার কোনো স্থান তাঁর জীবনে ছিল না।
যাঁরা গণ আন্দোলন করে, তাদের অনেক সময়ে দেখেছি খুব সামান্য কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে। সমর দা চাইতেন শুধু মেলাতে।
তাই তিনি সকলের কাছে ছিলেন এক চুম্ববের মতো। একটি কেন্দ্র।
দুটো ঘটনা মনে পড়ছে , একবার এক নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাবলম্বী ব্যক্তি সমর দার সাথে রাজনৈতিক বিষয়ে মতান্তর হওয়ায় কুৎসিতভাবে আক্রমণ করে। সমর দাও হতচকিত হয়ে আমায় বলেছিলেন ‘ মতে না মিললে এভাবে কেউ বলতে পারে ধারণা ছিল না। ‘ বছরখানেক ও গেল না, সেই ব্যক্তির সংগঠনে বিজ্ঞানের ক্লাস নিয়ে এলেন সমর দা। শুনে আমি যতটা হতবাক, ততটা রাগান্বিত। সমর দার বক্তব্য ‘ আরে ছাড়ো, আমাকে যা বলে বলুক। লোকটা একটা ভালো কাজ তো করছে। সেই কাজে থাকতে অসুবিধা কি! ‘
পুরুলিয়া থেকে ফিরছি আমি, সমর দা, আর সমর দার ভাগ্নী ডাঃ শর্মিলা চন্দ্র। রাত প্রায় দশটা। সবাই ক্লান্ত। হাওড়া স্টেশনে ব্যাটারি গাড়িতে চড়তে যাবো, হঠাৎ দুজন সিট খালি দেখে উঠে পড়লো। একজন বয়স্ক মহিলা। সমর দা, তৎক্ষণাৎ মহিলাকে জায়গা ছেড়ে সামনে চালকের পাশে বসলেন। জায়গা পর্যাপ্ত নয়, রীতিমতো ঝুঁকে আছেন। তারা আবার দাবী করে বসলো, তাদের আগে নামাতে হবে। আমি তো বটেই, শর্মিলা দিও কিঞ্চিৎ রুষ্ঠ। আমি যখন অনুযোগ করে, সমর দা কেন আগ বাড়িয়ে আগে গিয়ে বসতে গেলেন বলায় সমর দা, নির্বিকার। তাঁর উত্তর ‘ আরে, আমার তো কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না ‘।
সমর দা আমাকে পরিচিত করিয়েছেন পরিবেশ ভাবনার দিকে। অসংখ্য মানুষের সাথে তো বটেই। Admirer হওয়া কাকে বলে, সেটা ওঁকে জানলে জানা যেত। তার আগে পরিবেশ বিষয়ে কিছু জানতাম না, নিশ্চয় নয়। কিন্তু অবশ্যই ভাবতাম না এত কিছু। পরিবেশ এবং নিজের জীবন এক সূত্রে গাঁথা, এই বোধ সমর দা গেঁথে দিয়ে গেছেন।
সমর দা সাগর সমান। তাই যতদিন বাঁচবো, তাঁর কথা বলে যেতে হবে। লিখে যেতে হবে। আজ এর বেশী কিছু আর লিখতে পারছিনা।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ সভা থেকে ফেরার পথে আজ সন্ধ্যায় সমর দার কথা মনে এল। আজ সারাদিনই তাঁর কথা মনে আসছে। রাস্তা পারাপার হওয়ার সময়ে হঠাৎ চকিতে মনে হল পাশ দিয়ে চলে যাওয়া গাড়ি থেকে বুঝি এক্ষুনি সমর দা ডেকে উঠলেন ‘ এই যে ইয়ংম্যান। ভুলেই তো গেছ। ‘
২০২৩ র মার্চ মাসে আমাদের চম্পাহাটির বাড়িতে সমর দা যখন এলেন, সেই সময়ে ছবিটি আমি তুলেছিলাম।
[পাঠকের প্রতি বিশেষ অনুরোধ লেখাটি পড়ে অবশ্যই মূল্যবান মতামত কমেন্ট বক্সে দেবেন ।]
‐———————————————————
লেখক : অর্জুন অভিষেক রায়