Posted on: June 9, 2025 Posted by: Editor Desk Comments: 0
Spread the love

তেঁতুলতলা 

********

সেই কবেকার প্রবাদ :

যদি হই সুজন

তেঁতুল পাতায় নজন

এখানে বলি :

যদি তুমি সুজন হও 

 তবে তেঁতুলতলা বাঁচাও 

দক্ষিণ কলকাতার প্রান্তে এক বর্ষীয়ান তেঁতুল গাছ, সেই তেঁতুল গাছকে ঘিরে কত পাখি, কত কাঠবিড়ালি, কত হনুমান, কত নিঃসঙ্গ মৌ (solitary bee), আরও কত কত ছোটো ছোটো মৌমাছি, বোলতা, ভিমরুল, পোকা মাকড়, আরও ততোধিক ক্ষুদে ক্ষুদে, নানান ধরনের পিঁপড়ে, অসংখ্য খালি চোখে দেখতে না পাওয়া প্রাণী জীবন ধারণ করে আছে ।

একটা বড় তেঁতুল গাছ মানেই জীববৈচিত্র্যে ভরপুর জীবন ।

সেই জীব বৈচিত্র্যের অংশীদার কারা একটু দেখে নিই আমরা ।

এক প্রেমিক কোকিল ভোর থেকে ভর দুপুর, বিকেল থেকে মধ্যরাত অব্দি কখনও আবদারের সুরে,কখনও রাগী সুরে, কখনও কাকুতি মিনতির সুরে একটানা কুউয়ু কুউয়ু করে ডেকেই চলেছে প্রেমিকার মন পাওয়ার জন্য নাকি মান ভাঙ্গানোর জন্য ।

প্রেমিকার মন পাওয়ার পরেও ডাকার বিরাম নেই কারণ প্রেমিকা ডিম পাড়বে এদিকে প্রেমিকের বাড়ি ঘরদোর চাল চুলো নেই , তাহলে কারোর ঘরে চুপিসারে ঢুকতে হবে, প্রেমিকার জন্য ঘর খুজতে হবে ।

সেই চেষ্টায় কাকের বাসার পাশে অবিরাম কু উ উ, কু উ উ উ ডেকে ডেকে কাক কাকিনীকে চূড়ান্ত বিরক্ত করে বাসা ছাড়া করে কোকিলা কে অন্যের ঘরে ডিম পাড়ার ব্যবস্থা করে পুরুষ কোকিল ।

কাকের বাসা, কোকিলের আতুর ঘর সব এই তেঁতুল গাছের ডালে ডালে ।

সারাটা দিন ধরে কাঠবিড়ালীদের ছুটোছুটি করে গোল্লাছুট, এলাটিন বেলাটিন, চু-কিত-কিত, ছোঁয়া ছুয়ি খেলার বিস্তৃত গড়ের মাঠ এই তেঁতুল গাছ, সেইসঙ্গে সারাদিন ধরে ঠুকরে ঠুকরে তেঁতুল খাওয়া তো আছেই ।

আর টুনটুনি ! তারা তেঁতুলপাতা সেলাই করে বাসা বানাতে না পারলেও খেলার মাঠের দখলদারি নিতে ছাড়ে না, সারাদিন এ ডাল ও ডাল করে পোকা মাকড় জোগাড় করে ভুরিভোজ করার পাশাপাশি চিৎকার চেঁচামেচি করে লুকোচুরি খেলা চাইই চাই ।

বসন্তের বাতাস এলেই তেঁতুলের পাতায় ঝির ঝির তিরতির করে নাচন শুরু হয়, আর সেই পাতার আড়ালে বেনে বউ এর আনাগোনা শুরু হয়, আর মাঝেমাঝেই বউ কথা কও বউ কথা কও বলে হাকডাক , কখনও গম্ভীর মুখে খুঁজে চলে খাবার দাবার, তেঁতুলের ডালে ডালে বেশ নধর কিলবিলে মুককীট শুককীট দিয়ে বিরিয়ানি মহাভোজ চলে ।

কখনও সখনও পথ ভুলে হরিয়ালের ঝাঁক চলে আসে, তেঁতুলের ডালে দু দণ্ড জিরিয়ে যায়, হরিয়াল সে আবার কেমন ! 

হলুদাভ সবুজ সোনার বরণ তার গায়ের রঙ, ঠোঁট আর পা দুখানি হলুদ মাখামাখি, আকৃতিতে ঘুঘু বা পায়রার মতন ।

জীবনে একবার দেখতে পেলেই সার্থক জীবন ।

কখনও সখনও ভর দুপুরে সাদা বুক লম্বা ঠোঁট মাছরাঙা এসে দুদণ্ড জিরিয়ে যায় এই তেঁতুল গাছের ডালে ।

সব কি দু-পেয়েরাই শুধু তেঁতুল তলার বসিন্দা ?

মোটেই তা নয় !

চারপেয়েদের আনাগোনা ভালই আছে এখানে

কে আবার !

মুখ পোড়া হনুমানের দল,

তারাও চলে আসে দল বেঁধে হৈ হৈ করে ।

তেঁতুলের চাটনি না রাঁধতে পারলেও কাঁচা তেঁতুল পাকা তেঁতুল খেয়ে ফেলে ছড়িয়ে পাশের বাড়ির বিল্লি মিনির সাথে ছোঁয়া ছুয়ি খেলে , ছাদে দুমদাম লাফালাফি করে সারা পাড়ার লোকজনকে জানান দেওয়া চাই ।

দু পেয়ে চারপেয়ে ছাড়াও ছয়-পেয়ে , আট-পেয়েদের কথা না বললেই নয় ।

ছয় পেয়ে ! সে আবার কে !

মধুমৌমাছি গো মধুমৌমাছি ।

ডানা উড়িয়ে গুনগুনিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে সকাল থেকে বিকেল ফুলে ফুলে উড়ে উড়ে পায়ে পায়ে রেনু নিয়ে এই ফুল থেকে সেই ফুল করে ফুলের রস, ফুলের রেণু সংগ্রহ করে বাসায় নিয়ে জমিয়ে রাখে তাদের বাচ্চাদের জন্য ।

যতক্ষণ দিনের আলো ততক্ষণ ছুটোছুটি দৌড়াদৌড়ি করে ব্যস্ত্সমস্ত হয়ে কাজের শেষ নেই ।

দুষ্টু মানুষ এদের চাক বাসার সন্ধান পেলেই কালো ধোঁয়া দিয়ে মৌ-দের বিরক্ত করে তাড়িয়ে চাক ভেঙে মধু নিয়ে নেয় , চাক ভাঙ্গা মধু বলে অমৃত সমান ।

তাতে ওরা খুব একটা দমে যায় না ।

আবার প্রবল উদ্যমে ফুলের রস সংগ্রহ করতে শুরু করে ।

ওরা না এত্ত এত্ত তেঁতুল কিভাবে হবে ।

আর এক আছে একাকী মৌ (solitary bee) ।

ফুলে ফুলে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে তেঁতুল ডালের ফুটোয় সেধিয়ে যায় , ওখানেই ঘর বানিয়ে থেকে যায় রাতটুকু ।

এরা প্রেমিক প্রেমিকা একসাথে ঘর বাঁধেনা ।

বড্ড বেশি স্বাধীনচেতা সবাই ।

প্রেমের সময় টুকুই একসাথে গলাগলি ভাবসাব ।

তারপর যে যার ঘরে ।

স্ত্রী মৌ একা একাই বাসা বানায়, খাবার সংগ্রহ করে, বাচ্চাদের বড় হয়ে ওঠার সব আয়োজন করে ।

ডিম পাড়ার সময় হলে এর অদ্ভুত বাসা বানায় ।

 

কাছাকাছি বাড়িতে মেহগনি কাঞ্চন এইসব গাছ থাকলে নিপুণ ভাবে পাতার ধার থেকে গোল করে কেটে নিয়ে রোল করে পর পর সেই রোল একটার পর একটা ঢুকিয়ে নলাকৃতি বাসা বানায় গাছের। কান্ডের কোনো ফুটোয় ।

ডিম পাড়ে, খাবার রাখে তারপর বাসা বন্ধ করে দিয়ে চলে যায় ।

এই বাসায় পার্টিশান করা ঘর থাকে, ডিম ফুটে বেরোলে সবার জন্য আলাদা ঘর আলাদা খাবার, খাবার আর ঘর নিয়ে কোনো মারামারি কাটাকাটি করার প্রশ্ন নেই ।

এরা সিঙ্গেল মাদার, কত যত্ন করে বাচ্চার care এর ব্যবস্থা করে দূরে সরে যায় ।

এছাড়া আছে ক্ষুদে মৌমাছি apis florea ।

তারাও ছোট্ট শরীর নিয়ে এ ফুল থেকে সে ফুল করে উড়ে বেড়ায় ।

ইচ্ছে হলে তেঁতুল ডালের ফাঁকে ছোট্ট লম্বাটে ধরনের চাক বানিয়ে ঘর সংসার করে দলের সবাই মিলে ।

এবার কখনও পাহাড় থেকে নেমে আসে বড় পাহাড়ি মৌমাছির দল, তারা বিশাল বড় চাক বানায়, কখনও তোমার আশপাশে চলে এলে শুনতে পাবে হেলিকপ্টার এর মতন গোওওও আওয়াজ ।

অনেক দূর থেকে এদের মস্ত বড় চাক বাসা দেখা যায় ।

মানুষ যদি একবার জানতে পেরেছে এদের বাসায় মধু জমানোর খবর তাহলে ঢাল তরোয়াল নিয়ে যুদ্ধে নামার মতন দলবল নিয়ে চলে আসে সব তছনছ করে ওদের সংসার লণ্ডভণ্ড করে চাক ভেঙে মধু সংগ্রহ করে ।

পাহাড় থেকে সমতলে এসে ওরা বারবার ঘর ছাড়া হয় ।

তবুও হার মানে না ।

আছে নানানরকম আট পেয়ে মাকড়সা ।

এরা সব এ ডাল সে ডাল করে দুলে দুলে ঝুলে ঝুলে নিপুণ কায়দায় জাল বুনে মস্তবড় কায়দার চকচকে ফাঁদ বানিয়ে লুকিয়ে ওত পেতে থাকে জালে আটকানো শিকার ধরার জন্য ।

সন্ধ্যে হতে না হতেই কোত্থেকে চলে আসে চামচিকের দলবল ।

কলা বাদুড়ের বিয়েতে খ্যাংরা কাঠি দিয়ে বাজনা বাজাবে বলে রিহার্সাল দিতে আসে তেঁতুল তলায় ।

একটু রাত গভীর হলে বড় বড় ডানা মেলে নিঃশব্দে আসে বড় বাদুড় বাদুড়ি ।

ওদের দেখতে গেলে অন্ধকার ছাদে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে বসে থাকতে হবে ।

এবার দুই পেয়ে নিজেদের অতি বুদ্ধিমান ভেবে নেওয়া প্রাণীদের কথা শোনো ।

যারা একটুও ভাবনা চিন্তা না করে যখন তখন বড় বড় গাছ কেটে ফেলে নিজেদের বাড়ি ফ্ল্যাট রাস্তাঘাট বানাচ্ছে, স্বার্থপরের মতন নিজেদের কথা ছাড়া আর কোনো প্রাণীর কথা ভাবেনা যারা ।

সেই মনুষ্য প্রজাতির কথা বলি :

পৃথিবী তেঁতুল গাছ বিহীন হলে তারা কি কি হারাবে –

  • ছোটবেলায় কচি তেঁতুল পাতা চিবিয়ে না খেলে বৃথা তাদের শৈশব ।
  • কাঁচা তেঁতুলের অম্বল না খেলে বাঙালি জন্ম বৃথা ।
  • পাকা তেঁতুল ছাড়া ফুচকা প্রেমীদের জীবন যায় যায় ।
  • পাকা তেঁতুল ছাড়া মাছের টক জমবে না ।
  • পাকা টসটসে তেঁতুলের আচার যে একবার খেয়েছে তার জন্ম সার্থক হয়েছে ।
  • পাকা তেঁতুল নাহলে বাড়ির কাঁসা পিতলের বাসন মেজে সোনা চকচকে করা যাবেনা ।
  • তেঁতুল বীজ ছাড়া তো পুরুলিয়ার মহুল লাঠা হবে না কো ।

তেঁতুল তলার ছায়া আছে বলেই না প্রবল গরমেও শহরের বাড়ীতে শীতল আমেজ, এসি ছাড়াই দিব্যি চলে যাচ্ছে ।

 

এই মহাবৃক্ষ বুড়ো তেঁতুল গাছটি এতগুলো প্রাণ রক্ষা করছে ।

এই তেঁতুল গাছ রক্ষার জন্য কোমর বেঁধে লেগেছে একদল ভালো মানুষ ।

ছাদের ওপর মঞ্চ গড়ে তুলে সেখানে গান বাজনা নাটকের আসর বসছে মাঝে মাঝেই ।

হয়েছে একটা ইউ টিউব চ্যানেল ।

তেঁতুলতলার গান ।

দীর্ঘজীবী হোক –

তেঁতুলতলা

তেঁতুলতলার গান 

পৃথিবীর বুকে এই বুড়ো তেঁতুল গাছের অবদান অনেক ।

লেখিকা : মধুছন্দা ভট্টাচার্য


Spread the love

Leave a Comment