
“তালগাছ বজ্রপাত ঠেকায়” – শুনতে যতটা আশ্বাসজনক, ততটাই বিভ্রান্তিকর। আমাদের সমাজে বহু কুসংস্কার, অর্ধসত্য ও ভুল তথ্য প্রচলিত আছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো এই বিশ্বাস। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় অনেকেই মনে করেন, তালগাছ বেশি করে লাগালে বজ্রপাত কমে যাবে বা মানুষ বাঁচবে। আরও অবাক হতে হয় যখন দেখি কোনো শিক্ষক বা বিজ্ঞানকর্মীও বজ্রপাত ঠেকাতে তালগাছ লাগানোর উদ্যোগ নেন। এই ধারণার পেছনে এমনভাবে যুক্তি সাজানো হয়, যেন এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। কিন্তু সত্যি কি তাই ? বিজ্ঞান কি আদৌ এমন কিছু বলেছে ? না কি এটি কেবল প্রচারিত একটি কল্পকাহিনি, যার পেছনে বাস্তবতা নেই, বরং বিপজ্জনক বিভ্রান্তি রয়েছে ? এই প্রবন্ধে বিষয়টি নিয়েই যুক্তির আলোকে কিছু বলার চেষ্টা করবো।
বজ্রপাত একটি প্রকৃতিগত প্রক্রিয়া, যা মূলত বজ্রগর্ভ মেঘের মধ্যে ঋণাত্মক ও ধনাত্মক চার্জের পার্থক্যের কারণে ঘটে। সাধারণত উঁচু গাছ, টাওয়ার, বিদ্যুতের খুঁটি, খোলা মাঠ ইত্যাদি বজ্রপাতের ক্ষেত্রে আকর্ষণক হিসেবে কাজ করে। তালগাছ সাধারণত দীর্ঘকায় হয় ও এককভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। ফলে বজ্রপাতের সম্ভাবনা তাদের ওপর বেশি থাকে। আর ঠিক এইখানেই মূল বিভ্রান্তির সূত্রপাত। যেহেতু অনেক সময় গ্রামে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছে বজ্রপাত হয়, অনেকে ধারণা করেন, তালগাছ সেই বজ্রপাত নিজের ওপর নিয়ে অন্যদের বাঁচিয়ে দিচ্ছে। এখান থেকেই তালগাছ ‘বজ্রপাত ঠেকায়’ বলে একটা লোকবিশ্বাস তৈরি হয়। কিন্তু বিজ্ঞান কী বলে?
বজ্রপাত ঘটে যখন আকাশে বজ্রগর্ভ মেঘের মধ্যে বা মেঘ থেকে মাটির দিকে হঠাৎ করে ইলেকট্রিক চার্জ নিঃসরণ হয়। এটি একটি হাই-ভোল্টেজ বৈদ্যুতিক স্রোত, যা যেকোনো পরিবাহী বস্তু বা উচ্চতর বিন্দুকে আকর্ষণ করে। তালগাছ, যেহেতু দীর্ঘ, একাকী ও পরিবাহী, তাই প্রাকৃতিকভাবে বজ্রপাত তার ওপর পড়তেই পারে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, গাছটি নিজে থেকে কোনো ‘বজ্রনিরোধক’ কাজ করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তর (IMD), এবং United States’ National Weather Service (NWS)–এর মতো সংস্থাগুলোর মতে, বজ্রপাত থেকে বাঁচতে উঁচু গাছ বা একাকী গাছের নিচে দাঁড়ানো ঝুঁকিপূর্ণ। বরং উল্টো, তালগাছের নিচে দাঁড়ালে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ভারতে প্রতি বছর প্রায় ২০০০-২৫০০ মানুষ বজ্রপাতের কারণে মারা যান (সূত্র: NDMA, India)। এর মধ্যে অধিকাংশই ঘটে খোলা মাঠে, চাষের সময়, অথবা গাছের নিচে আশ্রয় নেওয়ার সময়। ২০১৮ সালের একটি গবেষণা অনুযায়ী, ৮০% বজ্রপাতজনিত মৃত্যু হয় গাছের নিচে আশ্রয় নেওয়ার ফলে। তালগাছও এর ব্যতিক্রম নয়। ফলে ধারণাটি যে কেবল অবৈজ্ঞানিক, তা নয়—এটি মৃত্যুঝুঁকিপূর্ণও।
তাহলে এখন প্রশ্ন হলো কেন এই গুজব ছড়ায়?
এর একক তায় উত্তর হলো লোককথা ও ধার্মিক বিশ্বাস। গ্রামবাংলার অনেক লোককথায় তালগাছকে ‘রক্ষাকারী’ বা ‘পবিত্র’ গাছ হিসেবে দেখানো হয়েছে। বজ্রপাত থেকে বাঁচার ঘটনা থাকলেও তার পেছনের প্রেক্ষাপটগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। একান্ত অভিজ্ঞতা থেকেই বিষয়টাকে সাধারণীকরণ করা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি যদি দেখে, তার বাড়ির পাশে তালগাছে বজ্রপাত হল অথচ সে বেঁচে গেল, তাহলে সে ধরে নেয় তালগাছ তাকে রক্ষা করেছে। এতে করে সে দৈবশক্তির কাজ হিসাবে ধরে নেয়। বাস্তবে তা কিন্তু বিজ্ঞানসম্মত নয়। আবার গ্রামে কোনো ধারণা প্রচার পেলে তা প্রচণ্ড গতিতে ছড়িয়ে পড়ে মুখে মুখে, এবং কেউ তার সত্যতা যাচাই করে না। সময়ের সঙ্গে এই ভুল ধারণাগুলো গুজবে রূপ নেয়।
তাহলে বিজ্ঞান কী বলছে ? বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের গবেষকগণ, এবং ভারতের বিভিন্ন মেটিওরোলজিক্যাল রিসার্চ ইন্সটিটিউটের রিপোর্ট অনুযায়ী, তালগাছ বা অন্য কোনো গাছ বজ্রপাত ঠেকাতে পারে না। বরং উঁচু গাছ বজ্রপাতকে আকৃষ্ট করে। তাই বজ্রঝড়ের সময় গাছের নিচে দাঁড়ানো উচিত নয়। ইউনেস্কো-স্বীকৃত “Lightning Protection Guide” (DEHN, Germany) অনুযায়ী বজ্রপাত প্রতিরোধের একমাত্র নিরাপদ ব্যবস্থা হলো– উপযুক্ত “Lightning Arrester” লাগানো, বৈদ্যুতিক সংযোগে আর্থিং থাকা, বজ্রঝড়ের সময় খোলা জায়গা বা গাছের নিচে না দাঁড়ানো।
এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে তালগাছের নিজস্ব কিছু উপকারিতা আছে, তবে সেগুলোর সঙ্গে বজ্রপাতের কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন: তালগাছ পরিবেশবান্ধব ছায়া ও অক্সিজেন দেয়। মাটি ক্ষয় রোধ করে। গ্রীষ্মে তালের রস, তালশাঁস, পাখির আবাসস্থল হিসেবে কাজ করে। কাঠ ও পাতা ব্যবহারযোগ্য হয়। কিন্তু এই উপকারিতাগুলোর সঙ্গে ‘বজ্রনিরোধ’ ক্ষমতা জুড়ে দেওয়া একটি ভুল প্রচার।
তালগাছ একটি উপকারী উদ্ভিদ, সন্দেহ নেই। কিন্তু “তালগাছ বজ্রপাত ঠেকায়”—এটি একটি অবৈজ্ঞানিক, বিভ্রান্তিকর ও বিপজ্জনক গুজব। এর পেছনে কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, বরং এর ফলে অনেকেই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে মৃত্যুর মুখে পড়তে পারেন। এই ধরণের গুজব দূর করতে স্কুল স্তর থেকে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ও সচেতনতা জরুরি। গণমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া, এবং স্থানীয় প্রশাসনকেও এই কাজে এগিয়ে আসতে হবে। আরও বেশি প্রয়োজন বিজ্ঞানভিত্তিক সচেতনতা, সঠিক তথ্যের প্রচার এবং গুজব প্রতিরোধ আইনি ব্যবস্থা। সমাজকে বাঁচাতে হলে, আমাদের মাথায় বিজ্ঞান থাকতে হবে, না হলে তালগাছের ছায়ায় থেকেও বজ্রপাতের মৃত্যু ঠেকানো যাবে না। তাই বলাই যায়, তালগাছ বজ্রপাত ঠেকায়—এটা নয়, বরং বিজ্ঞানই জীবন রক্ষা করে।
লেখক : প্রতাপ চন্দ্র দাস
বিশিষ্ট বিজ্ঞান লেখক প্রাবন্ধিক
[পাঠকের প্রতি বিশেষ অনুরোধ লেখাটি পড়ে অবশ্যই মূল্যবান মতামত কমেন্ট বক্সে দেবেন ।]