Posted on: May 24, 2025 Posted by: Editor Desk Comments: 0
Spread the love

কুচবিহার জেলার বানেশ্বর মোহনদেরকে ওদের মতো বাঁচতে দাও 

কয়েক বছর আগে কোচবিহার জেলার বানেশ্বর শিবমন্দিরের পাশে অবস্থিত শিবদীঘি হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছে পশ্চিমবঙ্গ জীব বৈচিত্র্য পর্ষদ। বানেশ্বর এর শিবদীঘিতে বসবাসকারী দুই প্রজাতির কচ্ছপ এখানে মোহন নামে পরিচিত। Tortoise ও Turtle এই দুটিকেই আমরা কচ্ছপ হিসেবে চিনি। বিন্যাস- বিধি দেখে পার্থক্যটি বুঝতে পারেন বিজ্ঞানীরা। এদের অর্ডার হল Testudines। এদের ফ্যামিলি আলাদা। এদের রয়েছে অনেক প্রজাতি। এদের একটি Black softshell turtle or Bostami turtle (Nilssonia nigricans) IUCN এর তালিকায় এটি বিলুপ্তপ্রায় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যদিও এদের কিছুটা অস্তিত্বের সন্ধান মিলেছে আসামের ব্রহ্মপুত্র নদীতে কাজিরাঙ্গা ফরেস্টের কাছে এবং অপর প্রজাতি Indian peacock softshell turtle (Nilssonia hurum) যা ময়ূরী কাছিম নামেও পরিচিত সেটিও IUCN এর তালিকায় লাল চিহ্নে চিহ্নিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের মানচিত্রে বানেশ্বর বিশেষ ভাবে আলোকিত হয়েছে এই মোহনকে ঘিরেই। একদিকে বানেশ্বর নামের পিছনে যেমন রয়েছে বিভিন্ন পৌরাণিক কথা ঠিক তেমনি মোহনকে কেন্দ্র করেও রয়েছে অনেক পৌরাণিক কথা। 

বানেশ্বর – বানাসুরের প্রতিষ্ঠিত শিবমন্দির বলে নাম বানেশ্বর। বাণ রাজার ঈশ্বর অর্থাৎ মহাদেব। এই গ্রামের পূর্ব নাম ছিল গের্দ সান্ডারা। গের্দ শব্দের অর্থ অঞ্চল। এই অঞ্চলে আশ্রম বানিয়ে বাস করতেন চংড়িয়া সাধু নামে সিদ্ধ পুরুষ। কালের নিয়মে পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছুই। কাহিনী গুলোও আজ পরিণত হয়েছে লোককথায়। আবার ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে কচ্ছপকে হিন্দু ধর্মে কূর্ম অবতার অর্থাৎ ভগবান বিষ্ণুর দ্বিতীয় অবতার বলা হয়েছে। মৎস অবতারের মতো কূর্ম অবতারও সত্য যুগের। ভগবান বিষ্ণুর শরীরের উপরের অংশ মানুষের এবং নিচের অংশ কচ্ছপের রুপ ধারণ করেন। আবার প্রাচীন গ্রীক দেবতা হার্মিসের প্রতীক ছিল কচ্ছপ। পৌরাণিক কাহিনী অথবা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ যাই থাকুক না কেন আজ বানেশ্বরের মোহনেরা রয়েছে অনেকটাই সংকটে। 

এদের সংকটের কারণ গুলো অনুসন্ধান করতে গেলে প্রথমে জানতে হয় এদের স্বভাব সম্পর্কে । সরীসৃপ প্রজাতির এই প্রাণী মাংসাশী, প্রজাতি ভেদে মিষ্টি জল ও নোনা জলের বাসিন্দা হলেও, মা-কচ্ছপ ডিম পাড়ে স্থল ভূমিতে। নরম মাটিতে বা বালিতে গর্ত করে ডিম পাড়ার পর এরা চলে আসে। কিছুদিন পর ডিম ফুটে বাচ্চা আবার সেই পথেই জলাশয়ে ফিরে আসে। কর্দমাক্ত জলাশয়ের শ্যাওলা, মশার লার্ভা, ছোট মাছ সহ অন্য জলজ প্রাণী, কচি ঘাস এদের প্রধান খাদ্য। ডিম পাড়ার জন্য এরা ডাঙায় উঠে আসার সময় বেছে নেয় নরম মাটির পথ। যাতে কচ্ছপের দেহের নিচের দিকের নরম অংশ যেন আঘাত প্রাপ্ত না হয়।

কচ্ছপের গড় আয়ু ৭০ থেকে ৮০ বছর হলেও কিছু কিছু কচ্ছপের আয়ু ২০০ বছরের বেশীও পাওয়া গেছে। যেমন আলিপুর চিড়িয়াখানার ‘অদ্বৈত’ ২০০৬ সালে মৃত্যুর সময় সে ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘজীবী প্রাণী। এরা দীর্ঘজীবী হয় কেন ? আরকানাস স্টেট ইউনিভার্সিটির শারীরবিদ্যার সহকারী অধ্যাপক লরি নিউম্যান- লি, যিনি কচ্ছপ এবং অন্যান্য সরীসৃপ নিয়ে গবেষণা করেন, তার মতে এর পেছনে দুটি উত্তরের কথা বলেছেন। একটি বিবর্তনীয় এবং অন্যটি জৈবিক উত্তর। কিন্তু দুটোই বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে বিভিন্ন স্থানের নগরায়ন ও আধুনিকতায় প্রগতিশীল সমাজের মানুষের ক্রিয়াকলাপে। ব্যাহত হচ্ছে তাদের জীবন। সেই ছোবল থেকে বাদ পড়েনি বানেশ্বরের মোহনেরাও। বানেশ্বরের দীঘিতে মোহনেরা আছে ঠিক কোন সময় থেকে বা এরা এখানে কী করে এল সেই সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য না পাওয়া গেলেও পুকুরের খনন কালের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় এরা বয়সে এখানে একেবারে নবীন নয়। কোচবিহারের ধর্মপ্রাণ মহারাজা প্রাণনারায়ণ-এর সময়কালেই এই অঞ্চলে বিভিন্ন মন্দির এবং ধর্মীয় স্থানগুলো নতুন ভাবে বিকশিত হয়েছিল। বানেশ্বর তার থেকে আলাদা নয়, এবং বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে অনুমান করা হয় মহারাজা প্রাণনারায়ণই এই কচ্ছপ আসাম থেকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন। কারণ এখানে বসবাসকারী কচ্ছপের প্রজাতিগুলোর একটির এখনো আসামের কিছু সংরক্ষিত এলাকায় হদিস মেলে। কয়েকশো বছর ধরে সুন্দর ভাবে বংশগতির ধারা বজায় রেখে মোহনের পরিবারের শ্রীবৃদ্ধিতে কোন ব্যাঘাত ঘটেনি। ছন্দ পতনের শুরু হয় নব্বইয়ের দশকে পুকুর খনন ও তার পরিচর্চাকে কেন্দ্র করে। সৌন্দর্যায়নের ও মোহন রক্ষণাবেক্ষণের নামে খনন কার্য শুরু হলো এবং সেইসাথে পুকুরের পাড় গুলো বাঁধানো হল কংক্রিটে। আধুনিকতার মোড়কে দিঘিটিকে ঘিরে ফেলা হল। ডিম পারতে যাওয়ার রাস্তা আটকে দেওয়ায় ওরা ক্ষতিগ্রস্ত হল। একদিকে কর্দমাক্ত মাটির অভাব ও খাদ্যের সঙ্কট এবং অন্যদিকে ওদের চলাচলের রাস্তা ব্যাহত করে, ওদেরকে আর ওদের মতন করে বাঁচতে দিলাম না আমরা। 

সেই সময় থেকেই এলাকার কিছু ধর্মপ্রাণ মানুষ ও কিছু পরিবেশ প্রেমী মানুষ মোহনকে রক্ষা করার তাগিদ অনুভব করে । ছাত্র শিক্ষক থেকে শুরু করে আপামর জনসাধারণ পথে নেমেছেন সেদিন থেকেই। মোহনদেরকে নিয়ে চলে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা। বেশ কয়েকবার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞ দলও এসেছেন। কিন্তু প্রশাসনিক স্তরে কিছু পদক্ষেপ গৃহীত হলেও প্রয়োজন আরও কিছু সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণের। গড়ে তোলা প্রয়োজন মোহনের বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ। চোরাচালান রোধের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। মোহনের বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতে গেলে আমাদের সকলেরই সহায়তা প্রয়োজন। মোহন যেহেতু বানেশ্বরের শিব দীঘিতেই সীমাবদ্ধ নেই তাই আশপাশের জলাশয়, ড্রেন, নালা সবেতেই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে, বন্ধ করতে হবে থার্মোকলের ব্যবহার। আসলে একসময় মোহন দর্শনার্থীরা মুড়কির ছোট মোয়া খেতে দিত মোহনদের। অনেকসময় থার্মোকলের বল গুলোকে ওদের খাবার ভেবে গুলিয়ে ফেলে। তাতে বিপত্তি ঘটার সম্ভাবনা প্রবল । জৈব অভঙ্গুর যেকোন জিনিসের ব্যাবহার অচিরেই বন্ধ করা একান্ত প্রয়োজন। প্রয়োজন এলাকার সমস্ত মানুষের মধ্যে মোহন সম্পর্কিত সচেতনতা। তাহলে একদিকে প্রায় ধংসের দিকে চলে যাওয়া থেকে মোহনকে রক্ষা করা যাবে ঠিক তেমনি প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে চোরাচালান। বানেশ্বর অঞ্চলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মোহনের ছবি দিয়ে সচেতনতার বার্তা দেওয়া যেতে পারে জনগণের কাছে। অঞ্চলের বিভিন্ন স্কুল কলেজে প্রকল্প রুপায়নে ছাত্র ছাত্রীদের উৎসাহিত করতে পারেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। অনেক সময়ই রাস্তাপারাপারে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে মোহনেরা, তাই বানানো প্রয়োজন মোহনের করিডর। প্রয়োজনে ফ্লাই ওভারের ব্যবস্থা করা। বিশেষজ্ঞ দল দ্বারা প্রতিনিয়ত এদের পরিচর্চা করা। মোহনের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলা অত্যন্ত আবশ্যিক। এদের গতিবিধি সম্পর্কে পরিপূর্ণ চর্চায় বিশেষজ্ঞ দল অবশ্যই যোগাযোগ রাখবে স্থানীয় মোহন সম্পর্কে ওয়াকিবহল মানুষজনের সাথে। দীঘির পূর্বদিকের যেসমস্ত স্থান ছিল তাদের প্রজননের উপযুক্ত পরিবেশ আজ সেসব তাদের অতীত, কিন্তু তারা খুঁজে পায়নি বিকল্প স্থান, তাই দিনে দিনে হ্রাস পেয়েছে তাদের সংখ্যা। বানেশ্বরের শিবদীঘির মোহন এখন ছড়িয়ে পড়েছে এলাকার আরও কিছু জলাশয়ে। প্রজননের জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারে সেইসমস্ত জলাশয়ের পাড় গুলিও। আমাদের উচিত তাদেরকে সহায়তা করা। 

IUCN তালিকায় বিলুপ্ত প্রায় অথবা বিপন্ন প্রাণীদের অস্তিত্ব বৃদ্ধির জন্য গবেষণার পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সকলকেই । আর বানেশ্বরের মোহনদেরকে নিয়ে রয়েছে এলাকার মানুষের অনেক আবেগ, ভালোবাসা এবং ধর্মীয় বিশ্বাস। তাই বাস্তববাদী চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে বিজ্ঞান সম্মত পরিকল্পনায় এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সকলকে। অন্যদিকে চোরাচালান প্রতিরোধ করতে প্রশাসনের সাথে সজাগ প্রহরীর ভূমিকাও গ্রহণ করতে হবে আমাদের সকলকে। ওদের জন্য ডিম পাড়ার জায়গা গুলোতে নিতে হবে ওদের উপযোগী বিশেষ ব্যবস্থা। তাহলেই হয়তো বানেশ্বরের মোহনেরা তাদের অস্তিত্বের সংগ্রামে জয়ী হয়ে IUCN লাল দাগ মুছে দিতে পারবে। তাই সকলে মিলে শপথ নেই, ওদেরকে ওদের মতো বাঁচতে দেই । 

লেখক : ড.তপন দাস 

বিশিষ্ট বিজ্ঞান লেখক প্রাবন্ধিক ও প্রধান শিক্ষক 

তথ্যসূত্রঃ

১। উত্তরের লোকায়ত জীবন ( প্রথম খণ্ড ), পর্বানন্দ দাস।

২। কোচবিহার দেব- দেবত্র- দেবালয়, উত্তর প্রসঙ্গ।

৩। কোচবিহারের লোকসংস্কৃতি বহুমাত্রা বহুস্বর, আব্দুর রহিম গাজী।  

৪। একের মধ্যে দুই, শৌভিক রায়, প্রকৃতি, বিজ্ঞান ও সমাজ বিষয়ক পত্রিকা, নভেম্বর ২০১৬।

৫। কচ্ছপ দীর্ঘজীবী হয় কেন ? অমিতাভ চক্রবর্তী, বিজ্ঞান অন্বেষক পত্রিকা, সেপ্টেম্বর- অক্টোবর, ২০২১।

বিশেযভাবে কৃতজ্ঞ: অর্ধেন্দু বণিক, পরিবেশ চিন্তক ছবি ঋণ : সুমন্ত সাহা, পরিবেশ চিন্তক

[পাঠকের প্রতি বিশেষ অনুরোধ লেখাটি পড়ে অবশ্যই মূল্যবান মতামত কমেন্ট বক্সে দেবেন ।]


Spread the love

Leave a Comment