Posted on: October 9, 2024 Posted by: Editor Desk Comments: 0
Spread the love

বাজি প্রাণঘাতী দূষণের উৎস : রাহুল রায়

মোটামুটি বিশ্বকর্মা পুজো থেকেই শুরু হয়ে যায় বাঙালির বর্ণময় নানান সামাজিক উৎসবের মরশুম। এসময় অতিমাত্রায় লাউডস্পিকার ব্যবহার, বাজি পোড়ানো, দীর্ঘসময় ধরে একই জায়গায় উপচে-পড়া ভিড়, যানজট, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ও জলের ব্যবহার, বেশি পরিমাণ বর্জ্য সৃষ্টি ইত্যাদি এক গভীর স্থানীয় পরিবেশ সমস্যা সৃষ্টি করে।

বাজি পুড়ে যেভাবে দূষণ ঘটে :

কালীপুজো, দীপাবলি ও ছট্পুজোয় বেলাগাম বাজি পোড়ে। দুর্গাঠাকুরের ভাসানের দিন থেকে এর মহড়া শুরু হয়ে যায়। এবছর মহালয়ার দিন ভোরবেলাতেই কিছু মফঃস্বলে বাজির শব্দ শুনতে পাওয়া গেছে। বাজিতে ভয়ানক বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণ হয়। শব্দবাজি ও আতসবাজি সাধারণত এই দুরকমের বাজি পোড়ানো হয়। শব্দবাজি তৈরির মূল উপাদান গন্ধক বা সালফার। এর সঙ্গে মেশানো হয় পটাশিয়াম নাইট্রেট, পটাশিয়াম ক্লোরেট, অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ইতাদি। এগুলি বিস্ফোরকের কাজ করে। জ্বালানির জন্য ব্যবহার করা হয় কাঠকয়লা। গন্ধক পুড়ে প্রচুর সালফার ডাইঅক্সাইড, পটাশিয়াম নাইট্রেট, পটাশিয়াম ক্লোরেট পুড়ে নাইট্রোজেন অক্সাইড ও কাঠকয়লার অসম্পূর্ণ দহনে প্রচুর কার্বন মনোক্সাইড, কার্বনডাইঅক্সাইড গ্যাস বাতাসে মেশে। বাজি তৈরিতে ব্যবহৃত নানা ধরনের কাগজ পুড়েও বাতাসে যথেষ্ট কার্বন মেশে। শব্দবাজি ফেটে প্রচণ্ড শব্দদূষণ ঘটে। শব্দবাজির প্রাবল্যে মানুষ সহ পশুপাখির অস্বস্তি বাড়ে।

আতসবাজি তৈরির মূল উপাদান লোহাচূর্ণ, তামাচূর্ণ, অ্যালুমিনিয়াম চূর্ণ, গন্ধক, বেরিয়াম, ব্যারাইটা, চুন, স্ট্রনশিয়াম হাইড্রক্সাইড, ফ্ল্যাশ পাউডার, ম্যাগনেসিয়াম, কাঠকয়লা ইত্যাদি। আতসবাজি পোড়ালে কী রঙ হবে, তা ঠিক করতে এসব উপাদান ব্যবহৃত হয়। আতসবাজি (বিশেষত তুবড়ি ও রঙমশাল) পুড়ে প্রচণ্ড ধোঁয়া হয়। সূক্ষ্ম কণাগুলি বাতাসে ভাসে। এতে বায়ুদূষণ ঘটে। এই ভারী ধোঁয়া মাটির ওপরের স্তরে জমা হয়। বাতাসে জলীয় বাষ্প বেশি থাকলে তার সঙ্গে মিশে এটি ধোঁয়াশা-র সৃষ্টি করে। আতসবাজিতে ব্যবহৃত ধাতুর পরিমাণ ও তার সূক্ষ্মতা বাড়লে এগুলি পোড়ানোর সময় যথেষ্ট তাপ সৃষ্টি হয়। জানা গেছে, রঙমশাল পুড়লে ১০০০ থেকে ১৬০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত তাপ সৃষ্টি হয়। তুবড়ির ক্ষেত্রে এটি ১২০০ ডিগ্রি থেকে ১৪০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হয়। ফলে স্থানীয় ভাবে বায়ুর তাপমাত্রাতেও এটি প্রভাব ফেলে।

কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাইঅক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড প্রতিটিই গ্রিনহাউস গ্যাস। এদের সঙ্গে বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা ও ধোঁয়াশা মিশে স্থানীয় বায়ুস্তরকে গরম করে তোলে। ধোঁয়াশায় দৃশ্যমানতা কমে। ফলে পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়। দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। বাতাসের গতিবেগ বেশি থাকলে ওপরের বাতাসের সঙ্গে নিচের বাতাস মিশে গরম বাতাস তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে যায়। আর গতিবেগ কম থাকলে ও শীতকালে যখন বাতাস ভারী থাকে, গরম বাতাস ওপরে উঠতে না পারায় নিচের বায়ুস্তরে উষ্ণতা বাড়ে। স্থানীয় বায়ুমণ্ডল ও আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাব উদ্ভিদজগতের ওপরেও পড়ে।

বাজি-দূষণে শারীরিক ক্ষতি :

বাজির ধোঁয়া ও ধোঁয়াশায় ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ডের সমস্যা হয়। ধোঁয়ায় মিশে থাকা অপেক্ষাকৃত বড় আকারের ধূলিকণাগুলি স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাসে বাধা দেয়। চোখ, গলা ও মুখের মিউকাস পর্দায় এরা আটকে যায়। ফলে জ্বলুনি হয়। অনেক সময় মিউকাস পর্দা চিরেও যায়। ছোট কণাগুলি সরাসরি ফুসফুসে যায়। ফলে গলা-চোখ জ্বালা, কাশি, হাঁপানি বাড়ে। ফুসফুস থেকে রক্তের মাধ্যমে ছোট কণাগুলি মস্তিষ্কে পৌঁছায়। এতে বড় ক্ষতির ভয় থাকে। অতি জোরালো শব্দে রক্তে শ্বেতকণিকার পরিমাণ বাড়ে। শর্করার মাত্রা বদলে যায় ও ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমে যায়। চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। আতসবাজির তীব্র আলোয় চোখ খারাপ হয়। স্নায়ুরোগ দেখা দেয়। শব্দবাজির উচ্চশব্দে গর্ভপাতও ঘটে। সদ্যোজাত শিশুর অঙ্গবিকৃতি ঘটতে পারে। সর্বোপরি ৯০ ডেসিবেলের বেশি শব্দে দীর্ঘক্ষণ কাটালে সাময়িক বা চিরকালীন বধিরতা দেখা দিতে পারে।

আইনি বেড়াজাল :

মহামান্য জাতীয় পরিবেশ আদালত কেবল বৈধ কিউআর কোড সহ সবুজ-বাজি পোড়ানোর ছাড়পত্র দিয়েছেন। বাজি মজুত রাখার ব্যাপারেও বেশ কিছু সরকারি বিধিনিষেধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, বাড়িতে কোনওভাবেই বাজি মজুত রাখা যাবে না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মাননীয় কলকাতা উচ্চ আদালতের শব্দদূষণ রোধে এক নির্দেশের প্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এক নির্দেশিকা জারি করে যে, বাজি ফাটানোর জায়গা থেকে পাঁচ মিটার দূরত্বে শব্দসীমা কখনোই ৯০ ডেসিবেল ছাড়াবে না। কিন্তু কী এক অজানা কারণে ঠিক এক বছর আগে এই নিয়মটিকে শিথিল করে শব্দসীমা ১২৫ ডেসিবেল করা হল, তার কোন সন্তোষজনক বিজ্ঞানসম্মত উত্তর রাজ্যবাসীর এখনও জানা নেই।

এখানে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, পুলিশ-প্রশাসন থেকে যে সব বিপুল পরিমাণ নিষিদ্ধ বাজি বাজেয়াপ্ত করা হয়, সেগুলির যথাযথ ব্যবস্থাপনা। আমরা এখনও ভুলে যাইনি, কয়েক বছর আগে উত্তর ২৪-পরগনার নৈহাটি অঞ্চলে বাজেয়াপ্ত বিপুল পরিমাণ নিষিদ্ধ বাজি পুলিশ-প্রশাসন থেকে গঙ্গাতীরে আগুন লাগিয়ে নষ্ট করার সময় ভয়ানক বিস্ফোরণ ঘটে। এতে স্থানীয় অঞ্চলে বেশ কিছু বাড়িতে ফাটল ধরে, এমনকি গঙ্গার বিপরীত পাড়ে চুঁচুড়া শহরের বেশ কিছু বাড়িতেও ফাটল ধরেছিল। তাই বেআইনি বাজি নষ্ট করার সময়েও যথাযথ সতর্কতার প্রয়োজন। উপরন্তু, খোলা আকাশের নিচে এভাবে আগুন দিয়ে নিষিদ্ধ বাজি নষ্ট করার সময়েও ভয়ানক বায়ুদূষণ ঘটে।

মহামান্য আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী সবুজ বাজিতে ‘ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর শংসাপত্র থাকতে হবে। কী কী রাসায়নিক যৌগ দিয়ে এটি বানানো, তার উল্লেখ থাকবে। নিষিদ্ধ রাসায়নিক বেরিয়াম ব্যবহৃত হয়েছে কিনা তা-ও জানাতে হবে। কিন্তু বাজারচলতি বেশিরভাগ সবুজ বাজিতে এসবের দেখা মেলা ভার।

এখানে বলা জরুরি, কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক শিল্পসংস্থাগুলিকে তাদের ‘দূষণ সূচক’-এর (পিআই) মান অনুযায়ী চারটি শ্রেণিতে ভাগ করেছে। যেমন- ‘লাল শ্রেণি’ (পিআই মান ৬০-এর বেশি), ‘কমলা শ্রেণি’ (পিআই মান ৪১-৫৯), ‘সবুজ শ্রেণি’ (পিআই মান ২১-৪০) ও ‘সাদা শ্রেণি’ (পিআই মান ২০-এর কম)। চরম আশ্চর্যের বিষয়, আমাদের রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কোনরকম পিআই মানের উল্লেখ ছাড়াই সবুজ বাজিকে সাদা শ্রেণিভুক্ত করেছে। বিশিষ্ট পরিবেশ ও সমাজকর্মী শ্রী বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় এখানেই প্রশ্ন তুলেছেন, বাজির মত মারাত্মক দূষণ সৃষ্টিকারী এক শিল্পকে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কেন এবং কীভাবে লাল শ্রেণি থেকে একেবারে কম দূষণকারী সাদা শ্রেণিতে সরালো, তা বিস্ময়কর। তিনি আরও জানান, ২০০৯ সাল থেকে রাজ্যে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অবৈধ বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে প্রায় একশো মানুষের প্রাণ গেছে।

‘ন্যাশনাল অ্যামবিয়েন্ট এয়ার কোয়ালিটি স্ট্যান্ডার্ড’ অনুযায়ী বাতাসে ২.৫-১০ মাইক্রোগ্রাম আকারের ধূলিকণার সহনীয় মান ১০০ মাইক্রোগ্রাম/ঘন মিটার, ২.৫ মাইক্রোগ্রাম আকারের কম ধূলিকণার সহনীয় মান ৩০ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার, সালফার ডাইঅক্সাইড ও নাইট্রোজেন অক্সাইড-এর সহনীয় মান ৮০ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার। কিন্তু কালীপুজো, দীপাবলি ও ছট্পুজোয় পশ্চিমবঙ্গের কোন শহরাঞ্চলেই উক্ত সহনীয় মাত্রাটি যে বজায় থাকে না তা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ওয়েবসাইট দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায়। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ১৭.১০.২৩ তারিখের এক আদেশনামায় শব্দবাজির তীব্রতার মাত্রা ৯০ ডেসিবেলকে শিথিল করে ১২৫ ডেসিবেল করে দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, ১২০ ডেসিবেলই হল অনুভূতিসম্পন্ন সহনশীল শব্দের শেষ ধাপ। এর পরেই শব্দের পীড়াদায়ক স্তর শুরু।

অতঃকিম্‌

রাজ্যে কোথায় সবুজ বাজির কারখানা আছে, বা এটি কীরকম দেখতে, তা সবার কাছে স্পষ্ট নয়। এক তথ্যসূত্রে (০৩.০৯.২৩) জানা গেছে, আমাদের রাজ্যে মাত্র ৭টি সবুজ বাজি তৈরির কারখানা আছে। বিপরীতে বেআইনি বাজি কারখানা আছে ৫৫৫৬টি। এই কয়টি মাত্র সবুজ বাজি কারখানা থেকে রাজ্যের বিপুল পরিমাণ বাজির চাহিদা কীভাবে মিটবে, তা নিয়ে প্রশাসন ও বাজি-বিক্রেতারা ফাঁপড়ে। চাহিদার জোগান দিতে সেক্ষেত্রে আড়ালে নিষিদ্ধ-বাজি বিক্রি হবে নাতো? গত বছরে আমাদের অনেকেরই এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, বাজারে সবুজ বাজির প্যাকেটের কিউআর কোড অ্যান্ড্রয়েড ফোনে স্ক্যান করলেও কোনও ধরনের শংসাপত্র বা এগুলি কী দিয়ে বানানো, তার কোনও তথ্যই পাওয়া যায়নি। এবারেও একই ঘটনা ঘটবে না তো?

শব্দবাজির দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে পশ্চিমবঙ্গে ১৪ জন মানুষ শব্দশহিদ হয়েছেন। তাই আগামী কালীপুজো, দীপাবলি ও ছটপুজোয় কীভাবে নিষিদ্ধ শব্দবাজি মানুষের হাতে আসা বন্ধ করা যাবে, সেটাই এখন বিভিন্ন পরিবেশপ্রেমী সংগঠন ও প্রশাসনিক কর্তাদের কাছে এক চরম অগ্নিপরীক্ষা। আমাদের এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, বাজি পোড়ানোর পর যে বর্জ্যের সৃষ্টি হয়, তা-ও বিপজ্জনক। বাজি তৈরি থেকে পুড়ে বর্জ্য হওয়া পর্যন্ত পুরো পর্বটাই বিপজ্জনক ও দূষণ-সৃষ্টিকারী। তাই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সমস্ত মানুষের কাছে আবেদন, যেকোনও ধরনের বাজি পোড়ানো থেকে দূরে থাকুন। দীপাবলি আলোর উৎসব। শব্দ ও দূষণের নয়। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, একজনের আনন্দ যেন কখনোই অন্যের দুঃখের কারণ না হয়।

লেখক : রাহুল রায়

পরিবেশকর্মী, ৯৪৩৩৫৭৫৩৬৪,

ই-মেইল: rayrahul2263@yahoo.co.in

কৃতজ্ঞতা: শ্রী বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়, সমাজ ও পরিবেশ কর্মী


Spread the love

Leave a Comment