
ভ্রমণ এবং পর্যটন
অজয় নাথ
আজ ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২৭ তারিখ। ১৪৩১ বঙ্গাব্দের ১১ই আশ্বিন(বিঃসিদ্ধান্ত) ১০ই আশ্বিন ( অন্যান্য পঞ্জিকা) ৫ই আশ্বিন ১৯৪৬ শকাব্দ। ২৭শে সেপ্টেম্বর দিনটি রাষ্ট্রসঙ্ঘের পর্যটন সংস্থা গ্রহণ করেছিল বিশ্ব পর্যটন দিবস হিসাবে সেই ১৯৭০ সালে। বিংশ শতকের সত্তরের দশকের আগে একদিকে যুদ্ধ বিগ্রহ এবং অন্য দিকে শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণা, নানা যুগান্তকারী আবিষ্কার ইত্যদিতে গোটা বিশ্ব মেতে ছিল। ১৯৬৯ সালে মানুষ প্রথমবার চাঁদের মাটিতে পা ফেলার সময় থেকে পৃথিবীর অস্তিত্ব নিয়ে নানা ভাবনা বলা ভালো দুর্ভাবনা শুরু হয়। পরিবেশ, খাদ্য, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, মানুষের স্বাস্থ্য, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ, মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক প্রভৃতি নিয়ে উদ্বেগ থেকে বিভিন্ন সময়ে এক একটি দিন নির্দিষ্ট হয়েছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের তরফে। বিশ্ব পর্যটন দিবসও একটি বিশেষ দিন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও তাদের নিজস্ব কিছু বিশেষ দিন রয়েছে। ১৯৭০ সালে ২৭শে সেপ্টেম্বর পর্যটন দিবস হিসাবে চিহ্নিত হলেও দিবসটি পালন শুরু হয়েছে ১৯৮০ সাল থেকে।
মানব সভ্যতার আদিযুগ থেকেই ভ্রাম্যমানতা শুরু হয়েছে মূলত খাদ্যের সন্ধানে। সেই ভ্রমণ ছিল যুথবদ্ধ। শুধুযে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া তা নয়। এক দেশ থেকে অন্য দেশ। এক মহাদেশ থেকে অন্য মাহাদেশে মানুষ পাড়ি জমিয়েছে বিভিন্ন কারণে। বলা হয় ৫৫ হাজার বছর বছর আগে আফ্রিকা মহাদেশ থেকে মানুষ এসে ভারতে বাস করতে শুরু করে। অনেকে মনে করেন ভারতের আদিবাসী বা বনবাসীরা তারও আগে ভারতে ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়ে উদ্ভুত হয়েছেন। আট হাজার বছর আগে কৃষি থেকে খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হওয়ার পর থেকে খাদ্যের জন্য স্থানান্তরে যাওয়া বন্ধ হয়। কিন্তু উদবৃত্ত শস্যের কি হবে ? যেখানে অভাব সেখানে পাঠানোর ব্যবস্তা করা। শুরু হলো অন্য ভ্রমণ। বানিজ্য যাত্রা। একদেশের পন্য নিয়ে অন্যদেশে যাওয়া। মানুষের খাদ্য বস্ত্র বাসস্থানের চাহিদা পুরণ হওয়ার পর শরু হয় জ্ঞানের বিকাশ । জ্ঞান অর্জনের জন্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া ।
মানব সভ্যতার আরও একটি দিক হল ইশ্বর ভাবনা যা থেকে ধর্মের উৎপত্তি। ধর্মের সাথে জড়িয়ে আছে প্রব্রাজ্যা। এভাবেই বিভিন্ন কারণে শুরু হয় ভ্রমণ।
ভারতীয় মহাকব্য রামায়ণের রাম শর্তাধীন হলেও উত্তর থেখে দক্ষিনে ভ্রমণ করেছেন। মহাভরতে পান্ডবদের ভ্রমণ করতে হয়েছে ভারতের পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ সর্বত্র। ঐতিহাসিক সময়ে ভগবান বুদ্ধ থেকে বিবেকানন্দ প্রব্রজ্যায় বেরিয়েছেন। বিবেকানন্দ ভারতের সর্বত্র পরিব্রাজনে শুধু গিয়েছেন তা নয় ভারতের আত্মাকে উপলব্ধি করেছেন নিজের শরীর এবং মন দিয়ে। সময়ের সাথে ভ্রমণের কারণ এবং পরিধি বেড়েছে। বিনোদন, বিশ্রাম, পারিবারিক বা সামাজিক মিলন, ব্যবসা, চিকিৎসা, শিক্ষা, তীর্থ দর্শন ইত্যাদি। তাছাড়াও আছে পর্বতারোহন, পাহাড় জঙ্গল নদী সমুদ্র ট্রেকিং এবং অভিযান। আমাদের দেশের সুপ্রাচীন সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিক্ষা ব্যবস্থা, ভৌগোলিক বিবিধতার আকর্ষণে টলেমি, ফা হিয়েন, হিউএনসাঙ, ইবন বতুতা প্রভৃতি পর্যটক এসেছেন। আধুনিক সময়ে এসে ভ্রমণ যুক্ত হয়েছে বাজার অর্থনীতির সাথে। ফলে ভ্রমণ হয়েছে পর্যটন যার একটা সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়েছে। আপন পরিচিত পরিবেশের বাইরে বিশ্রাম, ব্যবসা বা অন্য কোন কারণে এক বছর বা তার কম সময়ের জন্য যারা অবস্থান করেন তারা পর্যটক এবং পুরো ব্যবস্থা হলো পর্যটন।
Tour এবং tourism কথাটির মূল কোথায় তা নিয়ে তিনটি মত আছে। আর্মেনিয়ান tur শব্দ থেকে tour কথাটি এসেছে যার অর্থ অজানাকে জানার জন্য স্থানান্তরে অভিযানে যাওয়া। 1516 সালের চুক্তি অনুসারে ফরাসি ব্যাবসায়ী Della Tour ইংল্যান্ডে অবাধে ব্যবসা করার ছাড়পত্র পান। Della Tour এর নাম থেকে tourism কথাটি এসেছে। তৃতীয় মত হল দ্বাদশ শতকে ইউরোপে পরিযায়ী কৃষি শ্রমিকদের অন্য দেশে আসাজাওয়া থেকে tourism কথাটি এসেছে। ইউরোপীয় দেশে পর্যটন কথাটি যে ভাবেই আসুক না কেন আমাদের দেশে ভ্রমণের ইতিহাস এবং সামগ্রিক চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। প্রাক বৈদিক যুগ থেকেই কৃষি পন্যের ব্যবসার সূত্রে ভ্রমণ চলে আসছে। তাছাড়া শিক্ষা সংস্কৃতি ও জ্ঞানার্জনের কথা আগেই বলা হয়েছে।
বাঙালির পায়ের তলায় সর্ষে। বছরে ছুটি দুটি গ্রীষ্ম এবং শারদীয়া দুর্গা পূজো। এর কোনও একটি অথবা দুটিতেই বেরিয়েপাড়া ছেলেমেয়ের হাত ধরে। তাছাড়া অবসর প্রাপ্ত বাবা মায়েদের বাংলার বাইরে বা বিদেশে থাকা ছেলেমেয়েদের কাছে যাওয়ার বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন অনেকেই। নদী, সমুদ্র, পাহাড়, শহর, নগর, প্রাচীন স্থাপত্য, প্রত্যেকের আলাদা আকর্ষণ রয়েছে যা এড়িয়ে যাওয়া যায়না। অনেকে আছেন যারা দলবদ্ধ ভাবে ভ্রমণে যান। অনেকেই আছেন যিনি একাকী ভ্রমণে যেতে ভালোবাসেন। আমার পরিচিত অনেকেই আছেন যারা পাগলের মত প্রাচীন মন্দির ও সংস্কৃতির সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
এখন অল্প খরচে বিদেশে ঘুরতে যাওয়ার সুবন্দোবস্ত রয়েছে। অনেক পর্যটন সংস্থা রয়েছে এই কাজের জন। এভাবেই ভারতে পর্যটন শিল্প বছরে ছয় থেকে সাত শতাংশ হারে বাড়ছে। ভারতের বিবিধতা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির আকর্ষণে বহু বিদেশি মানুষ ভারতে আসেন। অবশ্য পর্যটনের সবকিছু যে মসৃণ ভাবে চলে তা নয়। পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে অতি বৃষ্টি, ধ্বস, হড়পাবানের মত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েন। ট্রেকিং বা পর্বত অভিযানে গিয়ে তুষার ঝড় বা এভালাঞ্চের মুখে পড়েন অনেকেই। কভিড মহামারীর জন্য দু বছর পর্যটন ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গোটা বিশ্ব জুড়ে ১২কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। অশান্তির জন্য কাশ্মীর, যাকে ভূস্বর্গ বলে, যাওয়া বন্ধ করেছিলেন বা ভয়ে ভয়ে যেতেন এখন সেখানে পর্যটকের সংখ্যা বছরে কোটি ছাড়িয়েছে। ভদ্রেশ্বর ভ্রমণ আড্ডার মত অনেক সংস্থা আছে যারা সরা বছর ধরে পর্যটন নিয়ে চর্চা করেন। বছরে এক দুবার আড্ডা বসিয়ে ভ্রমণের নানা বিষয়ে আলোচনা করেন, ছবির প্রদর্শনী করেন, ছোট ছোট ভিডিও বা ডোকোমেন্টরি দেখানো হয়।
পর্যটনের সাথে আবহাওয়া এবং জলবায়ু জড়িয়ে আছে। কোথাও বেড়াতে গিয়ে খারাপ আবহাওয়ার জন্য ঘরে বসে থাকা কাম্য নয়। আবার প্রতিকূল জলবায়ুর জন্য এক সময়ের পর্যটন গন্তব্য পর্যটন মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে পারে। আবার পর্যটন শিল্পের জন্য প্রকৃতি পরিবেশ এবং জীব বৈচিত্র্য ধ্বংস করে ফেলাও কোন কাজের কথা নয়। প্রতি বছর বিশ্ব পর্যটন দিবসের একটা থিম বা মচল বক্তব্য থাকে। এবারের থিম শান্ত বা বিশ্ব শান্তির জন্য পর্যটন। ইউরোপে দুবছরের বেশি সময় ধরে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। এশিয়াতে ইজরায়েল এবং প্যালেস্টাইনের মধ্যে যুদ্ধ চলছে প্রায় একবছর ধরে। যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে লেবাননেও। আমাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশে অশান্তির আগুন জ্বলছে। এবারের পর্যটন দিবসের হাত ধরে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্টিত হোক। যুদ্ধ অশান্তি বন্ধ হোক ।
[পাঠকের প্রতি বিশেষ অনুরোধ লেখাটি পড়ে অবশ্যই মূল্যবান মতামত কমেন্ট বক্সে দেবেন ।]
—————————————————————
কৃতজ্ঞতা স্বীকার (ছবিরজন্য) : গুগল
লেখক : অজয় নাথ, আবহাওয়া বিজ্ঞানী
যোগাযোগ, : 9433802339