
ভাদ্রমাসের চতুর্থ সপ্তাহ চলছে। খাতায় কলমে চার পক্ষের শরৎ কাল প্রায় শেষ হয়ে এল। দিন তিনেক আগে সকালবেলা হাঁটতে বেরিয়ে গাঢ় নীল আকাশের মুখোমুখি হয়েছিলাম।ণগ্রামের পথে হাঁটতে যাই বলে বাতসে শরতের স্নিগ্ধতা মিশেছিল। চারপাশে সবুজ আর সবুজের সমারোহ। আমাদের এই অঞ্চলে গাছপালা অনেক বেশি। অনেকেই তাদের বাড়ির সামনের রাস্তার পাশে গাছের চার বসাচ্ছেন। ভ্রমণ আড্ডার তরফে বেশ কিছু গাছের চারা বসানো হয়েছে পথের ধারে । সেগুলি বৃষ্টির জল পেয়ে তরতাজা হয়ে বাড়ছে একটু একটু করে । আমার ছোটবেলা কেটেছে আসামে। গাছপালা জল জঙ্গল আর পাহাড় আমার বেড়ে ওঠার সাথে জড়িয়ে আছে। তাই নীল আকাশ, সবুজ গাছপালা, বড়বড় পুকুর দেখলে মন প্রশান্তিতে ভরে উঠে। কিন্তু এখন এই সময় এক নির্মম হত্যাকান্ড বুকের ভেতর কাঁটার মত বিঁধে আছে। প্রকৃতির এই অকৃপণ দানের ভাগ তো সেই মেয়েটারও প্রাপ্য ছিল আরও বহু বছর ধরে । সে পেলনা । এই না পাওয়া এবং নির্মম হত্যাকান্ড ঘিরে অনেক প্রশ্ন যা মেয়েটির শহর, রাজ্য, দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও মানুষের মধ্যে ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়েছে । তার বহির্প্রকাশ ঘটছে মেয়েদের রাত দখলে। ছাত্রদের অভিযান এবং জুনিয়র ডাক্তারদের কর্ম বিরতি ও অবস্থান বিক্ষোভে। সাধারণ মানুষ এই আন্দোলন স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে সমর্থন করছেন। সরবরাহ করছেন খাদ্য ও পানীয় ।
টানা ৩৬ ঘন্টার উপর দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টি হয়েই চলেছে । স্মরণ কালের মধ্যে কবে এত দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টিপাত হয়েছে দক্ষিণ বঙ্গে আবহাওয়া দপ্তরের নথি ঘেঁটে বের করতে হবে । আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাভাস ছিল এবার বর্ষায় সারা দেশ মিলিয়ে স্বাভাবিকের তুলনায় ৬ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হবে তবে পূর্ব ও উত্তরপূর্ব ভারতে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হবে। গতকাল অর্থাৎ ১৪সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসেব গোটা দেশে ৮% বেশি এবং পূর্ব ও উত্তরপূর্ব ভারতে ১৬% কম বৃষ্টি হয়েছে। দক্ষিণবঙ্গে ঘাটতি ১৩% । তাতেও আমাদের মনে হচ্চে অনেক হয়েছে বাবা আর চাইনা । এমনিতেই বাজারে আলু কলা মূলো, বেগুন সব সব্জির দাম অনেক বেশি। আর বৃষ্টি হলে শীতের ফসল যা চাষ হয়েছে তা নষ্ট হয়ে যাবে । শাক সব্জির দাম কমবে না । আমাদের চাওয়া রোজ বৃষ্টি হোক কিন্তু একটানা নয় । এ হলো মধ্যবিত্তের চাওয়া । কিন্তু প্রকৃতির একটা নিয়ম আছে, আছে চলার ছন্দ । মানুষ সেই নিয়মের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ফলে প্রকৃতিও তার চলার নিয়ম এবং ছন্দ পাল্টেছে । আজ থেকে ৫০ /৬০ বছর আগে আমরা প্রকৃতির নিয়মের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে চলায় অভ্যস্ত ছিলাম । আগে আমরা ভূমিকম্প প্রবন এলাকায় হাল্কা বাড়িঘর তৈরি করতাম । এখন সেখানে বহুতল ইমারত তৈরি করছি । তাই ভূমিকম্প হলে লোকসানের বহর বাড়ে অনেকগুন । জলা বুজিয়ে জঙ্গল সাফ করে জমি বাড়াচ্ছি কৃষিকাজ আর বসবাসের জন্য । বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হচ্ছে । বিশ্বজুড়ে মহামারীর আউটব্রেক হচ্ছে । লক ডাউনে জীবন এবং জীবিকা হারাচ্ছি আমরা । কোভিড মহামারী পেরিয়ে সবে একটু স্বস্তির শ্বাস নিচ্ছি । তারই মধ্যে মাঙ্কিপক্স রক্ত চক্ষু দেখাচ্ছে ।
এই যে একটানা বৃষ্টি হলো তার কার্য কারণ সম্পর্ক ঠিক কী সেটা একটু দেখা যাক । অগাস্ট মাসের ৩০ তারিখ ফিলিপিন্সের কাছে একটা নিম্নচাপ তৈরি হয়েছিল । সেই নিম্নচাপ শক্তি সঞ্চয় করে ঘুর্ণিঝড় হলো । ফিলিপিন্সের উত্তরভাগ দিয়ে চলে এলো দক্ষিণ চিন সাগরে তিন দিনের মাথায় খানিকটা দুর্বল হয়ে । চিন সাগরে এসে আবার শক্তি সঞ্চয় করে ঘুর্ণিঝড়ে পরিনত হলো । পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ঘুর্ণি ঝড়ের তালিকা অনুযায়ী জাপানি আবহাওয়া দপ্তরের দেওয়া নাম Yagi ( ইয়াগী) তার ঘাড়ে চেপেগেল যার অর্থ মেষ । এই নামটা নেওয়া হয়েছে রাশিচক্রের দশম রাশি মেষ থেকে । হঙকঙ এবং চিনের হাইনান প্রভিন্স ছোঁয়ে ঘুর্ণিঝড় চলে এল ভিয়েতনামের দিকে ততদিনে ইয়াগী পঞ্চম স্তরের সুপার টাইফুনে পরিনত হয়েছে । সেপ্টেম্বর মাসের ৭ তারিখ ভিয়েতনামের কোয়াঙ নিন এবং হাইপঙের মধ্য দিয়ে উপকূল অতিক্রম করে । দুদিন ধরে ২০০ কিলোমিটার গতিবেগের ঝড়ো বাতাস, অতি প্রবল বৃষ্টিপাতের তান্ডব চলে । ভিয়েতনামের পরে দুর্বল হয়ে লাওস, থাইল্যান্ড এবং মায়ানমার হয়ে এসেছে বঙ্গোপসাগরে একটা নিরীহ ঘুর্ণাবর্ত হয়ে । সেই ঘুর্ণাবর্ত থেকে নিম্নচাপ, গভীর নিম্নচাপ এবং অতিগভীর নিম্নচাপ হয়ে বাংলাদেশ হয়ে দক্ষিণবঙ্গের উপর দিয়ে চলেছে ঝাড়খণ্ড হয়ে উত্তর পশ্চিম ভারতের দিকে ।
টাইফুন ইয়াগীর প্রভাবে সব মিলিয়ে ৭৮৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, আহত ২১৬৫ জন, নিখোঁজ ২৯৩ জন । টাইফুনের তান্ডবে বন্যায় ফসল নষ্ঠ, ঘরবাড়ি ভেঙ্গে মানুষের নিরাশ্রয় হওয়া ইত্যাদি সব মিলিয়ে অর্থ মূলে ক্ষতির পরিমান ১১ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার । দক্ষিণ চিন সাগরে পঞ্চম স্তরের সুপার টাইফুন হয় খুব কম । ১৯৫৪ সালের পর ইয়াগী চতুর্থ সুপার টাইফুন । ১৯৫৪ সালের পর সুপার টাইফুন হয়েছে ২০১৪ সালে ৬০ বছরের ব্যবধানে । পরের দুটি হলো ২০২১ এবং ২০২৪ সালে । বিজ্ঞানীরা অনেকদিন থেকেই বলে আসছেন মানুষ প্রকৃতির সাথে যে অন্যায় করে চলেছে তাতে ঘটেছে উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন । ফল হবে ভয়ঙ্কর । সুপার সাইক্লোন, সুপার টাইফুনের সংখ্যা বাড়বে । খরা বন্যার মত বিপর্যয় আসবে ঘন ঘন । মরুভূমিতে বন্যা হচ্ছে । দক্ষিণবঙ্গের সুন্দরবন অঞ্চলে বৃষ্টি এবং ঝড়ো বাতাসের ফলে ঘরবাড়ি গাছপালা ভেঙেছে, ভেঙেছে নদী বাঁধ । এবারের বর্ষায় ভারতের উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম সর্বত্র বেড়েছে চরম বৃষ্টিপাতের বা ২৪ ঘন্টায় ২০০ মিলিমিটার বা তার বেশি বৃষ্টিপাতের সংখ্যা । সাগর জলের তাপমাত্রা বাড়ার ফলে সাধারণ নিম্নচাপ বা ঘুর্ণাবর্ত থেকে ২৪ ঘন্টায় ৩০০ থেকে ৫০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টি হচ্ছে । এটা প্রকৃতির পাল্টামার ।
[পাঠকের প্রতি বিশেষ অনুরোধ লেখাটি পড়ে অবশ্যই মূল্যবান মতামত কমেন্ট বক্সে দেবেন ।]
—————–——————————————
লেখক:
অজয় নাথ, আবহাওয়া বিজ্ঞানী লেখক, দুরাভাষ – +919433802339