
লেখক : ড. শামীম হক মণ্ডল
সব হিসাব মেলে কি? মেলে না.. হ্যাঁ জীবনের মত মহাবিশ্বের বেলায় ও বুঝি এই কথা আরো বেশী করে খাটে।
এই যে মহাবিশ্বে এত কিছু আছে-গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ, এমনকি ব্লাক হোল অব্দি সব কিছুর সম্মিলিত ভর কত জানো? মেরেকেটে মহাবিশ্বের মোট ভরের পাঁচ শতাংশ। বিশ্বাস করো এই হিসেবের ভেতরে বিজ্ঞানীরা একটা প্রোটন, নিউট্রন , এমনকি কোনো ইলেকট্রনকেও বাদ দেননি। কি অবাক হলে তো! সব চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে বাকি ৯৫% কী আছে তা আমরা কেউই ঠিক করে জানিনা। এইখানেই বাঁধে গণ্ডগোলটা।
হিসাবের এই গলদটা প্রথম ধরা পড়ে, ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে। জুইকি নামক এক বিজ্ঞানী সে সময় ক্লাস্টার বা ছায়াপথগুলোর পাড়া নিয়ে কাজ করছিলেন। তিনি দেখান অজস্র ছায়াপথগুলি ক্লাস্টারের কেন্দ্রকে ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে। সেইরকম কিছু ছায়াপথের গতি প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি দেখেন ছায়াপথ গুলোর গড় গতিশক্তি অত্যন্ত বেশী। তাঁর গবেষণা থেকে আরো জানা যায় – ক্লাস্টারের সবকটা ছায়াপথই তাদের মুক্তিবেগের চেয়ে বেশী বেগ নিয়ে ছুটছে। আমাদের পৃথিবী পৃষ্ঠের কোনো বস্তুর মুক্তি বেগ, ১১.২ কিমি প্রতি সেকেন্ড, অর্থাৎ পৃথিবী পৃষ্ঠে কোনো বস্তুকে এই বেগ দিয়ে ছোটালে সে মহাকর্ষের মায়া ত্যাগ করে চিরতরে চলে যাবো। তাহলেই বোঝো ছায়াপথ বা গ্যালাক্সি গুলোর বেগ কতটা!
পদার্থবিজ্ঞানের চিরচারিত ধারণা অনুসারে এত জোরে ছুটে চলা গালাক্সিগুলোর সব কটিই এদিক ওদিক ছুটে চলে যাওয়ার কথা, এবং ক্লাস্টারটির কোনো হদিশ এতদিনে থাকার কথা ছিল না। কিন্তু মজার ব্যপার হলো প্রায় দশ বিলিয়ন বছর ধরে ক্লাস্টারটি বহাল তবিয়তে টিকে আছে। সেই থেকে,
পদার্থবিজ্ঞানীরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এই রহস্যের মোড়ক উন্মোচনের জন্যে।
জুইকি কাজ করেছিলেন ‘কোমো ক্লাস্টার’ নিয়ে। পরবর্তীতে অন্যান্য দিকপালরা দেখলেন আরো অন্যান্য ক্লাস্টারের ক্ষেত্রেও এটা সত্যি। অর্থাৎ গণ্ডগোল তো কিছু একটা হচ্ছেই। নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব কি এক্ষেত্রে খাটছেনা? আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব, নিউটনের তত্ত্বের পরিমার্জিত ও ব্যাপক রূপ। কিন্তু ক্লাসটারদের মধ্যে মহাকর্ষ বল এখনো এত বিশাল হয়ে ওঠেনি যে আইনস্টাইনের তত্ত্ব ব্যবহার করা যাবে। বিজ্ঞানীরা সে সময় একটা অদৃশ্য ভরের সম্ভাবনা অনুভব করলেন, তার শনাক্তকরণ সে সময় অসম্ভব ছিল। বিজ্ঞানীরা সেই পদার্থের নাম দিলেন ডার্ক ম্যাটার বা তমোপদার্থ।
পরবর্তীকালে ১৯৭৬ সালে বিশিষ্ট জ্যোতি পদার্থবিজ্ঞানী ভেরা রুবিন ছায়াপথ গুলো ভেতরে এরকম ভরের তারতম্য প্রত্যক্ষ করেন। ক্লাস্টারগুলির মতো ছায়াপথের কেন্দ্র কে ঘিরে নক্ষত্ররা প্রদক্ষিণ করে চলেছে অবিরত। যে নক্ষত্র ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে যত দূরে অবস্থিত তার বেগ তত বেশি হওয়া উচিত ছিল। দূরের নক্ষত্রটা ক্রমাগত তাদের গতিশক্তির কারণে কেন্দ্র থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তার ফলের কেন্দ্রমুখী বেগ হ্রাস পাওয়ার কথা। অথচ রুবিন দেখেন নক্ষত্রদের কেন্দ্রাভিমুখী বেগ আগের মত একই আছে।
সময় রেখা ধরে আমরা যদি একটু পিছিয়ে যাই, ওই ধরো মহাবিশ্ব শুরুর সময়ের অর্ধ মিলিয়ন অর্থাৎ পাঁচ লাখ বছর পরে গেলে দেখতে পাবো তখনকার মহাবিশ্বের পদার্থরা সবে মাত্র বুদবুদের মত জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। এই বুদবুদ গুলিই কালক্রমে বড়ো হতে হতে গ্যালাক্সি, ক্লাস্টার প্রভৃতিতে রুপ নেবে। কিন্ত তার সাথে মহাবিশ্বের আয়তন ও বাড়তে থাকবে পাল্লা দিয়ে। আগের পর্ব গুলোতে আমরা জেনেছি মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এদিকে আবার মহাকর্ষ চাইছে সব কিছুকে টেনে রাখতে। এই দুই বিপরীত শক্তির মাঝে টানাপোড়েন চলছে ক্রমাগত।
তোমরা স্কুলে শেখা গাণিতিক নিয়ম প্রয়োগ করলে দেখতে পাবে চেনা পদার্থের জন্যে সৃষ্ট মহাকর্ষ বলের সাহায্যে এই অসম লড়াই লড়া সম্ভব নয় – কোথাও যেন একটা বাড়তি ভর লুকিয়ে আছে, তা নাহলে এই মহাবিশ্বের কাঠামো এরকম হতো না, আর কোনো নক্ষত্র, ছায়াপথের অস্তিত্ব ও থাকতো না। সেই লুকিয়ে থাকা পদার্থই ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্ত পদার্থ বা তমোপদার্থ নামে পরিচিত। মহাবিশ্বের মোট ভরের প্রায় ২৮ শতাংশ জুড়ে এরা বিরাজমান। ডার্ক ম্যাটার মানে এটি কালো বর্ণের তা নয়, যেকোনো আলো এদের ভেদ করে যেতে পারে। এই ডার্ক ম্যাটার কোনো ধরণের বিকিরণের সাথে বিক্রিয়া করে না, এমনকি কোনো আলোতে এরা দৃশ্যমান হয়না।
ডার্ক ম্যাটার দেখতে কিরকম? এর প্রকৃতি কিরকম? এর অবস্থান কোথায়? এইধরনের গুচ্ছ গুচ্ছ প্রশ্ন গত এক শতাব্দী ধরে ব্যস্ত করে রেখেছে পৃথিবী বিখ্যাত একঝাঁক দিকপালদের। সার্নে অবস্হিত পৃথিবীর সব চেয়ে বড় কণা ত্বরক যন্ত্র, লার্জ হ্যাড্রোন কোলাইডারে বিভিন্ন ধরণের উচ্চ গতিসম্পন্ন কণাদের মাঝে সংঘর্ষে ঘটিয়ে বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত ডার্ক ম্যাটারের কণা আবিষ্কারের চেষ্টা করে চলেছেন। এইসব জটিল পরীক্ষা নিরীক্ষা গুলো সবসময় মাটির নীচে করা হয়, যাতে করে কোনো অনাকাঙ্খিত মহাজাগতিক কণার হিসাব বিজ্ঞানীদের প্রাপ্ত ফলাফলে না চলে আসে।
আমরা জানি প্রকৃতিতে মোট মৌলিক বলের সংখ্যা চারটি- মহাকর্ষীয় বল, তড়িচুম্বকীয় বল, ক্ষীণ বল ও নিউক্লিয়ার ষ্ট্রং ফোর্স। ডার্ক ম্যাটারকে শনাক্ত করতে গেলে আমাদের আগে জানতে হবে – কোন বিশেষ জাতের বল ক্রিয়া করে তাঁদের মাঝে। পর্যবেক্ষণ ভিত্তিক বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার দ্বারা এটা প্রমাণিত যে ডার্ক ম্যাটার বাস্তবে আছে। কিন্ত তাঁর প্রকৃতি আমাদের অজানা। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে জ্যোতি পদার্থবিজ্ঞানীদের গবেষণায় খুলে যাবে ১৪ বিলিয়ন বছর ধরে গড়ে ওঠা মহাবিশ্বের বিভিন্ন জট।
পঞ্চম পর্বের লিঙ্ক : https://bigyananneswak.org.in/2024/07/04/jyotirbigyaner-khoj-5th-part/
[পাঠকের প্রতি বিশেষ অনুরোধ লেখাটি পড়ে অবশ্যই মূল্যবান মতামত কমেন্ট বক্সে দেবেন ।]
—————————————————————–
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
1. Astrophysics for people in a hurry by Niel de Grase Tyson
2. The first three minutes… Steven Wienberg.
লেখক পরিচিতি : ড. শামীম হক মণ্ডল, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিচার সহায়ক বিজ্ঞান পরীক্ষাগারের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে কর্মরত। পদার্থবিদ্যায় PhD করেছেন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। গবেষণা করেন লো এনার্জি নিউক্লিয়ার রিয়াকশন ডাইনামিক্স নিয়ে। ভালোবাসেন মাতৃ ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার কথা বুনতে।
যোগাযোগ: shamimmondal709@gmail.com