
১৬০০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি, সমাজ বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক কলঙ্কিত দিন। ঐদিন হাজার হাজার মানুষের সামনে প্রকাশ্যে দিবালোকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় সত্যনিষ্ঠ দার্শনিক জিওনার্দো ব্রুনোকে। এই দিনটিকে আমরা বিজ্ঞান শহীদ দিবস হিসেবে পালন করি। ইতিহাসের পথ বেয়ে একবার ফিরে দেখা যাক।
পোলিশ জ্যোতির্বিদ নিকোলাস কোপার্নিকাস :
(১৪৭৩-১৫৪৩) মহাবিশ্বকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি আমূল বদলে দিলেন। টলেমির যুগ থেকে চলে আসা ভূকেন্দ্রিক মহাবিশ্ব ভাবনায় বিপ্লব সাধন করলেন তিনি। তিনি যুক্তি সাজালেন– পৃথিবী স্থির নয়, বরং সূর্যকে কেন্দ্র করেই পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহরা পাক খেয়ে চলেছে অবিরত। মহাবিশ্বের ভাবনায় চালু হল সূর্যকেন্দ্রিক সিস্টেমের (Heliocentric) তত্ত্ব। কোপাার্নিকাস লিখলেন– “সবকিছুর কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত সূর্য। তাকে যথার্থভাবে বলা হয় প্রদীপ, মন, বিশ্বের অধিপতি। সূর্য সিংহাসনে বসে যেন শাসন করে চলেছে তার সন্তান গ্রহদের, যে সন্তানরা অনবরত ঘুরে চলেছে তাদের পিতা সূর্যকে ঘিরে“। সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বকাঠামোর জনক কোপার্নিকাসকে ‘কোপারনি বিপ্লবের’ জনক বলেও অভিহিত করা হয়। অবশ্য ধর্মের ব্যাপারীরা তাঁকে অপদস্থ করতেও পিছপা হননি। ১৫৪৩ সালে প্রকাশিত হল কোপার্নিকাসের বই ‘দ্য রেভেলিউশনিবাস’। এর একমাস পরেই তিনি প্রয়াত হন।
কোপার্নিকাসের তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা হয়ে ওঠেন ইতালির এক সত্যনিষ্ঠ দার্শনিক জিওনার্দো ব্রুনো। তিনি বললেন –তারাগুলো আসলে সূর্যের মত জিনিস, সেগুলোকে ঘিরে ঘুরছে অনেক অনেক গ্রহ। তিনি এক দেশ থেকে অন্যদেশে সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার প্রচার করতে গিয়ে ধর্মের মাতব্বরদের রোষানলে পড়েন। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে ইতালির ধর্মীয় বিচারসংস্থা তাঁর জিভে পেঁরেক গেঁথে ও সারা শরীর আষ্টেপৃষ্ঠে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে ঐ অবস্থায় পুড়িয়ে মারেন ব্রুনোকে। পুড়িয়ে মারার আগে তাঁকে অবশ্য শেষ সুযোগ দেওয়ার উদারতা (!) দেখিয়েছিলেন ধর্মযাজকেরা। ব্রুনোকে বলা হল– ” তুমি যদি স্বীকার কর যে, কোপার্নিকাসের তত্ব ভুল তাহলে তোমাকে বেঁচে থাকার স্বাধীনতা দেওয়া হবে”। কিন্তু ব্রুনো বললেন – “আমি যা প্রচার করেছি তা সঠিক বলেই সজ্ঞানে করেছি, জীবনের বিনিময়েও ভুল স্বীকার আমি করব না“। মানবতার চরম অপমৃত্যু ঘটলেও সত্যের চাকা এভাবেই এগিয়ে চলে– ‘ধর্ম যখন বিজ্ঞানকে বলে রাস্তা ছাড়ো, বিজ্ঞান রাস্তা ছেড়ে দেয় না’।
এই রাস্তা ছেড়ে না দেওয়ার পথ ধরে আধুনিক বিজ্ঞানের জগতে প্রবেশ গ্যালিলিও গ্যালিলে-র। ১৬১০ সালের মধ্যে গ্যালিলিওর হাত ধরে সূচিত হল জ্যোতির্বিজ্ঞানের এক নতুন কালের, নতুন যুগের। দূরবীনে চোখ রেখে ধর্মীয় ‘মহান সত্য’ এর মুখোশ খুলতে থাকেন তিনি। আরিস্ততল বলতেন –চাঁদ স্বর্গীয়, পবিত্র, চাঁদের ভূভাগ মসৃণ কিন্তু গ্যালিলিও বললেন– চাঁদ নিতান্তই একটি উপগ্রহ। যার ভূভাগ গর্ত, পাহাড় ও উপত্যকায় পূর্ণ। ছায়াপথের দিকে দূরবীন তাক করে গ্যালিলিও আবিষ্কার করলেন ছায়াপথের অসংখ্য তারা। যে তারাগুলো ছড়ানো রয়েছে মহাশূন্যের গভীর অন্ধকারে। এরপর তিনি আবিষ্কার করেন বৃহস্পতির চারটি উজ্জ্বল উপগ্রহ বা চাঁদ। এইসবের ধারাবাহিকতায় তিনি আবিষ্কার করলেন শুক্রগ্রহের কলা। এও প্রমান করলেন যে শুক্রগ্রহ সূর্যের চারদিকে ঘোরে। এরপর তিনি দিনের পর দিন দূরবীনে চোখ রেখে ‘সৌর কলঙ্ক’ (black spot) এর হদিস দিলেন, এটাও আরিস্ততলের মতের বিরুদ্ধে যায়। আরিস্ততল বলেছিলেন –বিশুদ্ধ আকাশমণ্ডলে কোন কলঙ্ক থাকতে পারে না । তৈরি হলো গ্যালিলিওর অনেক অনুরাগী, অন্যদিকে বাড়তে থাকলো তাঁর শত্রু সংখ্যাও। তিন বন্ধুর কথোপকথনের মধ্য দিয়ে লেখা তাঁর বই ‘দায়ালোগো দেই দুয়ে মাসিমি সিস্তেমি’ বা দুটি প্রধান বিশ্বকাঠামো (টলেমি ও কোপার্নিকাসের মতবাদ) সম্পর্কে সংলাপ ১৬৩২ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর সারা বিশ্বে আলোড়ন পড়ে গেল,শঙ্কিত হলেন ধর্মযাজকরা। ১৬৩৩ সালে চার্চের বিচারে সারা জীবনের জন্য কারাদণ্ডিত হয়ে গৃহবন্দি গ্যালিলিও লেখেন গতি ও জাড্য সম্পর্কে আরেকটি অসাধারণ বই– ‘দুটি নতুন পদ্ধতি সম্পর্কে সংলাপ’। দূরবীনে চোখ রেখে দিনের পর দিন সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারান পরবর্তীকালে। নিজের দৃষ্টিশক্তির বিনিময়ে বিশ্ববাসীর কাছে উপহার দিয়ে গেলেন সৌরকলঙ্ক সহ আরো নানান আবিষ্কার। বিজ্ঞান এভাবেই এগিয়ে চলে। বিজ্ঞান কখনো ধর্মকে পথ ছেড়ে দেয় না।
বর্তমান সময়ের ভাবনা :
ভারত-মিশর-গ্রীস-ব্যাবিলন-আরব সহ পৃথিবীর সব দেশেই জ্যোতিষশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞান একটা সময় পর্যন্ত মিলেমিশে কাজ করত। জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাথে মিলে ছিল ধর্মভাবনা- কল্পনা-রূপকথা। আস্তে আস্তে এই ধর্মই ধারণ করল জ্যোতিষশাস্ত্রকে। বুজরুকি ও অপবিজ্ঞানকে ভর করে জ্যোতিষশাস্ত্র মানুষ ঠকানোর এক ব্যবসায় পরিণত হল।
অথচ বিজ্ঞানের আধুনিক তত্ত্ব ও প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে জ্যোতির্বিজ্ঞান একটি যথার্থ প্রকৃতিবিজ্ঞান হয়ে উঠল। ধর্মের ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা জ্যোতিষশাস্ত্রকে দূরে সরিয়ে প্রকৃত জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চাকে আজ দিক থেকে দিগন্তে, পৃথিবী থেকে সূর্যে, সূর্য থেকে মহাকাশে-মহাবিশ্বে ছড়িয়ে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আজ আর কোন একটি রাষ্ট্রের বিষয় নয়, তা আজ অনেক বেশি করে আন্তর্জাতিক। এখনো পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত মহাবিশ্বের নানান রহস্যের সমাধানে সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা যৌথভাবে কাজ করছেন, বিজ্ঞান গবেষণায় নানান আন্তর্জাতিক সংস্থা গড়ে উঠেছে। অভিকর্ষ তরঙ্গ (gravitational wave)’র শনাক্তকরণ, কৃষ্ণগহ্বরের ছবি তোলা, নাসার সৌরযান (Parker Solar Probe) পাঠানো, মহাকাশে অত্যন্ত উচ্চমানের ও উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন টেলিস্কোপ পাঠানো একবিংশ শতকে সম্ভব হচ্ছে সব দেশের সব বিজ্ঞানীর নানা আবিষ্কার ও তাঁদের অভিজ্ঞতা এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতির সমাহারে। এই জার্নি চলবে যতদিন থাকবে মানুষ। মানব মননের বিকাশ চলতেই থাকবে যতদিন থাকবে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতা। তাই বাতিল হয়ে যাওয়া ধর্মীয় ভাবনা নয়, বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমাদের বারেবারে তাকাতে হবে আকাশের পানে। চিনতে হবে গ্রহ-উপগ্রহ-নক্ষত্রমন্ডলী সহ পুরো মহাবিশ্বকে। বিজ্ঞানকে শুধু বইয়ের দু’ মলাটে বন্দী করে না রেখে, কোন কিছুই অন্ধভাবে না মেনে প্রশ্ন করার অভ্যেস তৈরি করতে হবে। সমস্ত ঘটনায় তার কার্য-কারণ সম্পর্ককে সামনে আনতে হবে, একটা বিজ্ঞানমনস্ক মন তৈরি করতে হবে। বুঝতে হবে বিজ্ঞানের সাথে প্রকৃতির গভীর সম্পর্ককে। এটাই আজকের সময়ের দাবি।
আকাশে তারাদের দেখা মানে আমরা দেখতে পাব আমাদের অতীতকে। আমরা এই মুহূর্তে যে সূর্যকে দেখছি, সেই সূর্য আসলে প্রায় আট মিনিট আগের সূর্য। কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরে থাকা একটি নক্ষত্রকে রাতের আকাশে দেখা মানে – ঐ তারা থেকে অতদিন আগে জন্ম নেওয়া আলোকরশ্মি আমার চোখে এসে পৌঁছাচ্ছে ঠিক এই মুহূর্তে। মনে রাখতে হবে একটি মানুষের অবস্থান এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীবের সমান। মহাবিশ্বের প্রতিটি প্রাণ নক্ষত্রের ধূলো থেকে তৈরি– এই চরম সত্য বিস্মৃত হলে বিজ্ঞান-অর্থ-উন্নত মস্তিষ্কের গর্বে গরবী মানুষের সমূহ বিপদ। আমরা এসব ভুলে মেরে যতই টাকা, ব্যাংক- ব্যালেন্স ও ভোগ্যপণ্যের বাজারের দিকে ছুটি না কেন, সদা প্রসারমান এই বিপুল বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তাতে কিছু যায় আসে না। বরং এই পৃথিবীতে মানবসভ্যতার অবলুপ্তি ঘটলেও অনন্তকাল ধরে বয়ে চলবে এই বিপুলা ব্রহ্মাণ্ডের অনন্ত গতি। তাই জ্যোতিষশাস্ত্র নয়, অন্ধবিশ্বাস নয়, ধর্মীয় গোঁড়ামি নয়– সভ্যতার চাকা দুর্নিবার গতিতে এগিয়ে চলুক আধুনিক বিজ্ঞান, প্রকৃতিবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই। তবেই কোপার্নিকাস, ব্রুনো, গ্যালিলিও, আইনস্টাইন, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, আচার্য্য জগদীশ চন্দ্র বোস, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন বোস, স্টিফেন হকিং, পেনরোজ সহ প্রমুখ বিজ্ঞানীদের দেখানো পথে হেঁটে বিজ্ঞান মনস্কতা, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, যুক্তিবাদ, বস্তুবাদ: এর সুউচ্চ ধ্বজাকে পতপত করে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
[পাঠকের প্রতি বিশেষ অনুরোধ লেখাটি পড়ে অবশ্যই মূল্যবান মতামত কমেন্ট বক্সে দেবেন ।]
—————–—————————
লেখক:
সন্তোষ সেন, শিক্ষক ও পরিবেশ কর্মী,
মো:9674468060