Posted on: August 30, 2024 Posted by: Editor Desk Comments: 0
Spread the love

আর জি কর হাসপাতালের তরুণী চিকিৎসকের নারকীয় খুন-ধর্ষণে শোকাতুর ও ক্ষুব্ধ রাজ্যবাসী যখন ন্যায়বিচারের দাবিতে অটল, তখন আর এক নারীর নৃশংস হত্যার ঘটনা ঘটে গেল স্বাধীনতা দিবসে ঝাড়গ্রাম জেলায়। ভরাভরতি অন্তঃসত্ত্বা এই নারীর পিঠে জঙ্গলের এক পোড়োবাড়ির উপর থেকে জলন্ত গনগনে লাল ছয় ফুটের এক লোহার ছুঁচলো শলাকা বিঁধিয়ে দেওয়া হল। হোক না সে না-মানুষী। কিন্তু তাই বলে এমন বর্বরতা! আমরা রোজ বর্বরতার আর কত নয়া শীর্ষনজির গড়ব! সেই না-মানুষীর দোষ? দু’টি শাবকসহ পাঁচটি বুনোহাতির দলের মধ্যে সে এবং অন্য একটি মাদি হাতি ঝাড়গ্রামের শহুরে এলাকায় ভোরবেলায় প্রথমে ঢুকে পরে রাজ কলেজের কাছে আশ্রয় নেয়। এখান থেকে হুলাপার্টি যখন তাদের তাড়ানোর চেষ্টা করে, তখন তার পিঠে জ্বলন্ত শলাকা বেঁধানো হয়।

জ্বলন্ত লোহার শলাকা পিঠে বিঁধিয়ে দেওয়ায় অন্তঃসত্ত্বা এই হাতিটি যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকে। জ্বলন্ত শলাকাটি সহজে তার পিঠ থেকে খসেওনি। প্রায় মিনিট পাঁচেক এভাবে থাকার পর হাতিটির পেছনের দুটি পা অসাড় হয়ে যাওয়ায় তার আর সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা ছিল না। কোনমতে শুঁড় দিয়ে শলাকাটি বের করে পিছনের পা দুটি ঘষটে এগোতে থাকে। পরে হাতিটি মারা যায়। এতে ক্ষুব্ধ স্থানীয় জনতা হাতি তাড়ানোর হুলাপার্টিকে দায়ী করে এবং বনকর্মিদের ওপর চড়াও হয়। প্রসঙ্গত বলার, মহামান্য সর্বোচ্চ আদালতের ২০১৮ সালের এক আদেশে হাতি তাড়ানোর জন্য জ্বলন্ত শলাকা বা বর্শার ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ।

 বর্বরতার আর এক নজির :

কেরালা রাজ্যে পালাক্কা জেলার সাইলেন্ট ভ্যালি জাতীয় উদ্যানের পাশের এক গ্রামে ১৫ বছর বয়সী দু’মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক হাতি আতশবাজি ভরা এক আনারস খায়। আতশবাজিগুলো হাতির মুখের ভেতর ফেটে যায়। দুঃসহ যন্ত্রণায় হাতিটি দিক্বিদিক ছুটে বেড়িয়ে একসময় নদীতে নেমে জলের ভেতর মুখ ও শুঁড় ডুবিয়ে থাকে পোড়ার জ্বালাযন্ত্রণা কমাতে। পরে এই নদীতেই ২৭ জুন ২০২০ সালে তার মৃত্যু হয়। হাতিটি চার দিন ধরে চুপচাপ নদীতে দাঁড়িয়েছিল। অন্তঃসত্ত্বা এই হাতিটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন বনকর্মী ও পশুচিকিৎসকেরা। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। বন বিভাগের কর্মকর্তা মোহন কৃষ্ণান জানিয়েছেন, তীব্র যন্ত্রণায় হাতিটি যখন পাগলের মতো গ্রামের রাস্তা দিয়ে ছোটাছুটি করেছে, তখনও সে একজন মানুষকেও আক্রমণ করেনি।

 না-মানুষীর মৃত্যুমিছিল :

বিগত পাঁচ বছরে ভারতে ৫২৮টি হাতির অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। এই একই সময়ে মানুষ-হাতি সংঘাতে বিপরীত দিকে প্রায় ২৮৫৩ জন মানুষ মারা গেছে। কেবল ২০২৩ সালেই মারা গেছে ৬২৮ জন মানুষ। ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড এবং পশ্চিমবঙ্গে এই মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

২০২৩ সালে কেন্দ্র সরকারের পরিবেশ মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী কীর্তিবর্ধন সিং লোকসভায় এক প্রশ্নোত্তরে জানান, বিগত পাঁচ বছরে দেশে ৩৯২টি হাতির বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু ঘটেছে। এদের মধ্যে ৭১টি মারা গেছে ওড়িশা-য়, অসম-এ ৫৫টি, কর্নাটক-এ ৫২টি, তামিলনাড়ু-তে ৪৯টি, ছত্তিশগড়-এ ৩২টি, ঝাড়খণ্ড-এ ৩০টি এবং ২৯টি হাতির মৃত্যু ঘটেছে কেরালা রাজ্যে। তথ্যের অধিকার আইনে জানতে চাওয়া প্রশ্নের উত্তরে ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রক জানিয়েছে যে, ২০১৪ থেকে ২০২০ সালে ৪৭৪টি হাতি দেশে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যায়। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অসম রাজ্যে (৯০টি)। এরপর রয়েছে ওড়িশা (৭৩টি), তামিলনাড়ু (৬৮টি), কর্ণাটক (৬৫টি) এবং কেরালা (২৪টি)।

বিগত পাঁচ বছরে ট্রেন দুর্ঘটনায় দেশে ৭৩টি হাতির মৃত্যু হয়েছে বলে শ্রীসিং জানান। ট্রেন দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি হাতিমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে অসম (২২টি) এবং ওড়িশা-য় (১৬টি)। চোরাশিকারিদের হাতে মারা পড়েছে ৫০টি হাতি (ওড়িশা-য় ১৭টি, মেঘালয়-এ ১৪টি, তামিলনাড়ু-তে ১০টি)। এছাড়াও বিষ খাইয়ে ১৩টি হাতিকে মেরে ফেলা হয়েছে (অসম-এ ১০টি, ছত্তিশগড়-এ ২টি এবং পশ্চিমবঙ্গ-এ ১টি)। উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে দেশের হাতিগণনা অনুযায়ী ভারতে মোট হাতির সংখ্যা ২৯,৯৬৪ (সমগ্র পৃথিবীর হাতিসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ)।

তামিলনাড়ু-র বন দপ্তরের ‘এলিফ্যান্ট ডেথ অডিট ফ্রেমওয়ার্ক’-এর তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১০ সাল থেকে এই রাজ্যে ১৫০৫টি হাতির মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে ১৫৯টি হাতির মৃত্যু (মোট হাতিমৃত্যুর ১০.৫%) হয়েছে মানুষের হাতে। ২০১০ সাল থেকে মোট ১২৮টি হাতির মৃত্যু হয়েছে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে। হাতি-মানুষ সংঘাতে ৭৬টি হাতিকে খুন করা হয়েছে। এখানে প্রতি দশটি হাতিমৃত্যুর মধ্যে একটি ঘটে অস্বাভাবিকভাবে। মোট হাতিমৃত্যুর মাত্র ১.৭ শতাংশ (২৭টি মৃত্যু) ঘটেছে পরিণত বয়সে বার্ধক্যের ফলে। মোট হাতিমৃত্যুর ১.৬ শতাংশ (২৪টি মৃত্যু) ঘটেছে খাদ্যাভাবে।

 ক্যাগ প্রতিবেদন :

কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল অফ ইন্ডিয়া-র (ক্যাগ) প্রতিবেদনে (ডিসেম্বর, ২০২১) দেখা যাচ্ছে, ২০১৬ থেকে ২০১৯ সালে হাতির অস্বাভাবিক মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণটি হল ট্রেন দুর্ঘটনা। এই সময়ে অন্তত ৬১টি হাতি ট্রেনে কাটা পড়েছিল। লোকসভায় দেওয়া রেলমন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে দেশে ট্রেন দুর্ঘটনায় ৪৫টি হাতির মৃত্যু হয়েছিল। এই একই সময়ে ১৫০টিরও বেশি অন্যান্য বন্যপ্রাণী ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিল। ট্রেনে কাটা পড়ে হাতিমৃত্যুর সংখ্যাটি আলোচ্য সময়ে প্রায় দ্বিগুণ (১০ থেকে ১৯টি) হয়। অন্য বন্যপ্রাণীদের বেলায় এটি প্রায় দেড়গুণ (৪৪ থেকে ৬৯টি) বেড়ে যায়। ভারতবর্ষের রেলপথ-এর বিভাগীয় অঞ্চলগুলির মধ্যে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত (সদরদপ্তর গুয়াহাটি) রেলপথে দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ১৫টি হাতির মৃত্যু ঘটেছিল আলোচ্য এই তিন বছরে। ২০১৯ সালে মারা গিয়েছিল ৪টি হাতি, ২০২০-তে ৬টি এবং ২০২১ সালে ট্রেনে কাটা পড়েছিল ৫টি হাতি। রেলপথে হাতিমৃত্যু ঠেকাতে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশিকা মেনে ডুয়ার্স-এ আলিপুরদুয়ার-শিলিগুড়ি শাখায় বিকেল ৫টা থেকে সকাল ৫টা অব্দি ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চালানো হয়। মহানন্দা অভয়ারণ্যের মধ্যে বাগরাকোট থেকে গুলমা অব্দি দিনের বেলাতেও এই একই গতিতে ট্রেন চলে।

 তাহলে ?

পরিকল্পনাশূন্য উন্নয়ন প্রকল্প, চাষবাসের ধরন পরিবর্তনে জমি-ব্যবহার, বন্যপ্রাণী-অধ্যুষিত অঞ্চলে কাণ্ডজ্ঞানহীন পর্যটন, বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং উদ্ধত নগরায়নে ভারতে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ক্রমশ কমছে। টান পড়ছে তাদের খাদ্যের ভাঁড়ারে। খাবারের খোঁজে বন-লাগোয়া গ্রাম বা শহরে তারা চলে আসছে। তখন দেখা দিচ্ছে মানুষ-হাতি সংঘাত। দল বেঁধে গ্রামে এসে এরা খেতের ফসল খেয়ে নিচ্ছে। মানুষ স্বভাবতই বাধা দিতে গেলে হাতিরা মাঝেমধ্যেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে বাড়িঘরদোর ভেঙে দিচ্ছে। কখনো বা মানুষও মেরে ফেলছে। এতে মানুষেরও ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে। যেনতেন প্রকারেণ নিজেদের জীবন-জীবিকা ও সম্পত্তি বাঁচানোর চেষ্টাই তখন বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। গ্রামে এবং বিশেষ করে শহরে এসে হাতিরা আর একটি বিপদের মুখে পড়ছে – বিদ্যুতের লাইন। বন্যপ্রাণীদের বাসভূমি বা আবাসস্থল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রশাসনের। কেন্দ্রীয় প্রকল্প ‘প্রোজেক্ট টাইগার অ্যান্ড এলিফ্যান্ট’-এর মাধ্যমে বন্যপ্রাণীদের সুরক্ষা, তাদের আবাসস্থল সংরক্ষণ এবং মানুষ-বন্যপ্রাণীর সংঘাত দূর করতে কেন্দ্র সরকার আর্থিক ও প্রাযুক্তিক সাহায্য করে। বন্যপ্রাণী এবং তাদের বাসভূমি রক্ষায় এগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ঝাড়গ্রামের নৃশংস ঘটনার পরে পশু সুরক্ষা সংস্থা ‘ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান অ্যানিম্যাল প্রোটেকশন অর্গানাইজেশন’ মানুষ-হাতি সংঘাতে মানুষ ও হাতির মৃত্যুজনিত ঘটনা সমাধানে কয়েকটি প্রস্তাব করেছে। যেসব জায়গায় হাতি-মানুষ সংঘাতজনিত সমস্যা কিছুটা সুরাহা করা গেছে, পশুপ্রেমী নানান স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্য ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। হাতি তাড়াতে হুলাপার্টিকে অনেক ভেবেচিন্তে ব্যবহার করতে হবে। আপাতত এদের কাজ বন্ধ রাখাও যেতে পারে। শেষে অবশ্যই বলার, এভাবে হাতি বা অন্য বন্যপ্রাণী মৃত্যুর ঘটনা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কখনোই খুব একটা কল্কে পায় না, বা নির্বাচনী প্রচারে রাজনৈতিক দলগুলির ইস্যুও হয় না, যেহেতু বন্যপ্রাণীদের কোন ভোট ব্যাংক নেই। আর তাই, এই হবু-মায়ের জন্য জ্বলেনি কোনও মশাল বা মোমবাতি।

[পাঠকের প্রতি বিশেষ অনুরোধ লেখাটি পড়ে অবশ্যই মূল্যবান মতামত কমেন্ট বক্সে দেবেন ।]

—————–‐————————————-

লেখক:

বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়, সমাজ ও পরিবেশকর্মী, চলভাষ- ৮৪২০৫২৯৯৬৬, ই-মেল: biswajit.envlaw@gmail.com

এবং

রাহুল রায়, পরিবেশকর্মী, চলভাষ- ৯৪৩৩৫৭৫৩৬৪, ই-মেল: rayrahul2263@yahoo.co.in


Spread the love

Leave a Comment