
আপনার দৃষ্টিতে মৃত্যুর পরেও দুজন দৃষ্টিহীন দৃষ্টি ফিরে পেতে পারেন, তবে বর্তমানে সর্বাধিক সাত জনে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছে।
‘অন্ধজনে দেহো আলো
মৃতজনে দেহো প্রাণ’
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কথাকে আদর্শ মেনে আমরা রাখী পত্রিকার তরফ থেকে নদীয়া জেলা কে কর্নিয়াজনিত দৃষ্টিহীন জেলা হিসাবে গড়ে তোলার একটা বৃহৎ পরিকল্পনা নিয়েছি।
তারই অঙ্গ হিসাবে প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে মরণোত্তর চক্ষুদানের সাথে সাথে দেহদানকে সার্বজনীন ভাবে গ্রহণযোগ্য করার চেতনাকে সারা নদীয়া জেলা ব্যাপী রাখী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রয়াত শ্যামল রঞ্জন সরকারের ভাবনাকে আমরা বয়ে নিয়ে চলছি।
বর্তমানে নদিয়া জেলার কল্যাণীসহ বৃহৎ অঞ্চল, চাকদহ, কৃষ্ণনগর, শান্তিপুর, নবদ্বীপ, পলাশী, তেহট্ট ও করিমপুরসহ বৃহৎ অঞ্চল নিয়ে কর্নিয়া সংগ্রহের জন্য আমরা একটা বড় রকম পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছি।
সাথে সাথে সেই সেই এলাকার বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, রক্তদাতা সংগঠন, ক্লাব, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহ সকলের মধ্যে চক্ষুদান সম্বন্ধে একটা জনচেতনা গড়ে তুলতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছি।
তবে সকলের মধ্যে কয়েকটি কথা আমাদের পৌঁছে দিতেই হবে এটা আমাদের অঙ্গীকার।
পৃথিবীর মোট দৃষ্টিহীন ব্যক্তির এক-তৃতীয়াংশ ভারতবর্ষে বাস করেন ।
বিশেষজ্ঞদের মতে ৩০ রকম কারণে দৃষ্টিহীনতা হতে পারে ।
আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার ২.৫ % মানুষ কোন না কোন ভাবে দৃষ্টিহীনতা জনিত কারণে ভুগছেন।
শিশুরাই মূলত কর্নিয়া জনিত দৃষ্টিহীনের শিকার ।
আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার ১১.৫ % শিশু ।
এই শিশুদের ৫৭ % অপুষ্টিতে ভুগছে সেই কারণে অপুষ্টি দূর করার আন্দোলনে সকলকে সারা বছর ধরে যুক্ত থাকতে হবে।
দৃষ্টিহীনতার অন্যতম কারণ অপুষ্টি ।
চোখে আঘাত।
চোখের উপরের অংশ সাদা হয়ে যাওয়া ।
এইগুলি কর্নিয়া নষ্ট হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
কর্নিয়া জনিত দৃষ্টিহীনতা নিরাময়ের একমাত্র পথ হল কর্নিয়া প্রতিস্থাপন ।
এই কর্নিয়া কোন কলকারখানা বা ল্যাবরেটরীতে তৈরি হয় না। একমাত্র মৃত মানুষের টাটকা কর্নিয়া সংগ্রহের মাধ্যমে এর প্রতিকার সম্ভব ।
আসুন আমরা সকলে মিলে কর্নিয়া দান করি এবং কর্নিয়া জনিত দৃষ্টিহীনতা থেকে মানুষকে মুক্ত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই এবং জেনে নেই কয়েকটি বিষয়:
# চোখের মনির উপরের দিকে অর্থাৎ চোখের কালো অংশকে ঘিরে থাকে যে স্বচ্ছ পর্দা, সেটাই কর্নিয়া।
অর্থাৎ ঘড়ির কাঁচের মতন ব্যাপার।
# কর্নিয়ার ভেতর দিয়ে যতদিন পর্যন্ত আলো যাতায়াত করতে পারে ততদিন আমরা দেখতে পাই।
যখন কর্নিয়া কোন আঘাতের ফলে অস্বচ্ছ হয়ে যায় বা সংক্রমণ বা অন্য কোন উপায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায় তখন সেই কর্নিয়া আর দেখার জন্য কাজ করে না।
# মৃত মানুষের টাটকা কর্নিয়া সংগ্রহ করে যাদের কর্নিয়া খারাপ হয়ে গেছে তাদের কর্নিয়াকে বদলে দিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাকে কর্নিয়া প্রতিস্থাপন বলা হয়।
# চক্ষুদানের ক্ষেত্রে বয়সের কোন সীমানা নেই।
# সুগার প্রেসারের রোগী এমনকি যারা চশমা পরে থাকেন তারাও কর্নিয়া দান করতে পারেন।
তবে মৃত্যুর পরে কেবলমাত্র বাড়ির লোকেরা ও নিকট আত্মীয়-স্বজনেরা যদি কর্নিয়া সংগ্রহ কেন্দ্রে ফোন করেন তাহলে সম্পূর্ণ বিনা পয়সায় তারা এসে আপনার বাড়ি থেকে কর্নিয়া দুটি সংগ্রহ করে নিয়ে যাবে।
# চোখের কালো অংশ যেটাকে চোখের মনি বলি তার উপরের স্বচ্ছ টিস্যুটি হল কর্নিয়া, এটিকে অপারেশন করবার বাঁকানো কাঁচি দিয়ে সংগ্রহ করাকে বলা হয় কর্নিয়া সংগ্রহ করা।
এই কর্নিয়া সংগ্রহ করার ফলে চোখের কোনরকম বিকৃতি হয় না।
কর্নিয়া সংগ্রহ করার পরে চোখের পাতা দুটো বুজিয়ে দিলে কেউ বুঝতেই পারবেন না মৃতদেহ থেকে কর্নিয়া দান করা হয়েছে।
মুখেরও কোনরকম বিকৃতি হয় না।
# মৃত্যুর ৬ ঘণ্টার মধ্যে কর্নিয়া সংগ্রহ করতে হয়।
# কর্নিয়া দানের জন্য মৃত্যুর এক ঘণ্টার মধ্যে সরকারি নিয়মে আছে চিকিৎসক ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে দেবেন।
# কর্নিয়া সংগ্রহ করতে ২০-২৫ মিনিট সময় লাগে তারপরে আপনি ইচ্ছে করলে মৃতদেহ দান করতে পারেন বা অন্য যে কোন উপায় অবলম্বন করতে পারেন ।
তবে মৃত্যুর পরেও এই দেহ যেমন কর্নিয়া দানের ক্ষেত্রে কাজে লাগে অর্থাৎ দুজন দৃষ্টিহীন নতুন করে দৃষ্টি ফিরে পেতে পারেন আবার তেমনি মৃতদেহ দানের মাধ্যমে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্ররা চিকিৎসার প্রয়োজনে গবেষণার কাজে, ডিসেকশনের কাজে, রোগ নির্ণায়ক ময়না তদন্তের কাজে লাগাতে পারেন ।
সেই কারণে মৃতদেহ দান করাই সবচেয়ে ভালো উপায়।
# কর্নিয়া সংগ্রহের সাথে সাথে গলার শিরা থেকে ৩- ৪ মি:লি: গ্রাম রক্ত সংগ্রহ করেন কারণ মৃত ব্যক্তি কোন সংক্রামক ব্যাধির জীবাণু যেমন : জন্ডিস, এইডস, রেবিশ, সিফিলিস, টিটেনাস ও সেফটিসমিয়া রক্তে আছে কিনা পরীক্ষা করার জন্য।
এগুলির কোন একটি থাকলে মৃতের কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের কাজে ব্যবহার করা হয় না কিন্তু গবেষণার কাজে ব্যবহার করা হয়।
অর্থাৎ কর্নিয়া দানের ক্ষেত্রে এই জাতীয় রোগ থাকলে মৃতের কর্নিয়া কোন কাজে লাগে না।
# যারা কর্নিয়া সংগ্রহ করবেন বা যে পরিবার কর্নিয়া দান করবেন তারা কেউই কোন ভাবে কোন তথ্য জানতে পারবেন না অর্থাৎ কার চোখে আপনার দেওয়া কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হলো সেটি জানতে পারবেন না ।
এই দান সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাদান এই দানের বিনিময়ে কোন অর্থ মূল্য পাবেন না এমনকি কর্নিয়া কেনা – বেচা সবকিছুই বে-আইনি।
আমরা নদীয়া জেলা থেকে কর্নিয়া জনিত দৃষ্টিহীনতা দূর করতে যেসব পরিকল্পনা নিয়েছি যা প্রায় তিন দশক ধরে অনেকটা কার্যকরী অবস্থায় রয়েছে অর্থাৎ জনচেতনার কিছু অংশ।
কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে দৃষ্টিহীনতার অন্যতম কারণ অপুষ্টি। এই অপুষ্টি দূর করবার লড়াইয়ে সকলকে সামনে সারিতে নিয়ে আসা এ কাজ শুধুমাত্র রাখীপত্রিকা কেন কোন সংগঠনের ক্ষেত্রেই এককভাবে সম্ভব নয়।
রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে সকলের পুষ্টির জন্য অত্যন্ত সচেতন ভাবে আন্তরিকভাবে কাজ করাই একমাত্র পথ।
আসুন আমরা সকলে মিলে বাকি অংশ বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করি।
তবে আমরা নই একা, আজকে আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছে নদীয়ার বিভিন্ন প্রান্তের নানা চিন্তা ভাবনার মানুষেরা।
তাদের একটি মাত্র লক্ষ্য কর্নিয়া জনিত দৃষ্টিহীনতাকে দূর করতে রাখী পত্রিকার এই যুগান্তকারী কাজে সকলে যুক্ত করে দৃষ্টিহীনে দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়ে মৃত্যুর পরেও অন্যের দৃষ্টিতে বেঁচে থাকার ইচ্ছেকে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করা।
___________________________________
প্রতিবেদন : বিমল সরকার।
সভাপতি রাখী পত্রিকা (নদিয়া জেলার সর্বপ্রথম মরণোত্তর দেহদান ও চক্ষুদান বিষয়ক আন্দোলনকারী সংস্থা), বাদকুল্লা, নদীয়া।
(তথ্যগুলি রাখী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মরণোত্তর দেহদান চক্ষুদান আন্দোলনের প্রাণপুরুষ শ্যামল রঞ্জন সরকার রচিত “মৃত্যু অমৃত করে দান “পুস্তক থেকে নেওয়া। )