Posted on: August 13, 2024 Posted by: Editor Desk Comments: 0
Spread the love

মানভূমে ফ্লোরাইড সংক্রমণ: কয়েক লক্ষ মানুষ আক্রান্ত দাঁত ও হাড়ের ক্ষয়রোগে।

মানুষের শরীরে ফ্লোরিন ঢোকে মূলত পানীয় জলের মাধ্যমে। এছাড়াও কোল্ড ড্রিঙ্কস সহ বিভিন্ন পানীয়তে কিছুটা মাত্রায় ফ্লোরিন মেশানোর চল আছে। ফলাহার থেকেও জুটে যায় কিছুটা ফ্লোরাইড যৌগ। অথচ মাটির নিচের জলস্তলে কোনভাবে ফ্লোরিন-ঘটিত যৌগ বেশি পরিমাণে মিশে যাওয়ার পর সে জল ব্যবহার করলে শরীরে ফ্লোরারাইড সংক্রমণ শুরু হয়। যার ফলে দাঁত দুর্বল হয়ে ভেঙে পড়ে। দাঁতের সাথে সাথে ক্ষয়ে যেতে শুরু করে শরীরের হাড়। 

আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান পত্রিকা ‘বিএমসি পাবলিক হেলথ’ এ অতি সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে –পুরুলিয়া এবং প্রতিবেশী ঝাড়খণ্ডের সিংভূম জেলার বিস্তৃর্ণ অঞ্চলের কয়েক লক্ষ মানুষ ফ্লোরাইড দূষণের প্রভাবে দাঁত ও হাড়ের ক্ষয়েরোগে ভুগছেন। সিধো-কানো -বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের অধ্যাপক বিশ্বজিৎ বেরা ও অরিজিৎ ঘোষ, সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক সৌমজিৎ পাত্র এবং যোগেশ চৌধুরী কলেজের ভূগোলের অধ্যাপক সুমনা ভট্টাচার্য: এই চার গবেষক পুরুলিয়া এবং সিংভূমের ৬৭টি গ্রামে সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন – ওইসব গ্রামের ৫৪ শতাংশের বেশি মানুষের শরীরে সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেকটাই বেশি পরিমাণে ফ্লোরিন ঘটিত যৌগের নমুনা পাওয়া গেছে।

এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক বিশ্বজিৎ বেরা বলছেন – আগে আর্সেনিক সংক্রমণ নিয়ে প্রচুর আলোচনা, গবেষণা ও তর্কবিতর্ক হতো। বর্তমানে ফ্লোরাইড সংক্রমণও ভয়ানক জায়গায় পৌঁছে গেছে। এই নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। মানবদেহে অনুমোদিত ফ্লোরিন যৌগের মাত্রা হল এক লিটার জলে ০.৬-১.২ মিলিগ্রাম। অথচ এইসব অঞ্চলের অনেক জায়গাতে লিটারে ১৫ থেকে ২০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত ফ্লোরিনের সন্ধান মিলেছে। অর্থাৎ সহনশীল মাত্রার অনেক ওপরে। উল্লেখ্য যে, কিছু কোম্পানি টুথপেস্টে অপ্রয়োজনীয় ফ্লোরাইড মেশান। বাড়তি মুনাফার লোভে বিজ্ঞাপনী মোহজালে মানুষকে বিভ্রান্ত করে এইসব বাড়তি ছাইপাঁশ মেশানো হয়, যা শরীরের কোন উপকারে আসে না, বরং শেষ বিচারে দাঁতের ক্ষতিই করে।

[ মানবদেহে ফ্লোরাইড দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব ]

কেন এমনটা হচ্ছে? প্রকাশিত রিপোর্টের চার গবেষক জানাচ্ছেন – সিংভুম ও মানভূমের মালভূমি বয়সে হিমালয়ের থেকেও প্রবীণ। এই মালভূমি অঞ্চল তৈরি হয়েছে মূলত নিস ও পিগামাইট শিলায়। মাটির নীচে শিলাস্তরে নানান ধরনের খনিজ আকরিক মিশে রয়েছে। বিগত কয়েক দশকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো এখানেও বিপুল পরিমাণে ভূগর্ভস্থ জল কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। মাটির তলাকার জলস্তর ক্রমশ কমে যাওয়াতেই মাটির গভীরে লুকিয়ে থাকা আর্সেনিক ও ফ্লোরিন যৌগ পানীয় জলে মিশছে মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে।

অর্থাৎ নানাবিধ শিল্পসংস্থার কাজে, বোতলবন্দী ঠান্ডা পানীয় ও জলের ব্যবসাতে এবং কর্পোরেট পরিচালিত তথাকথিত হাইব্রিড চাষে অপরিকল্পিতভাবে যথেষ্ট জল তুলে নেওয়ার ফলে আর্সেনিক দূষণের সাথে সভ্যতার নতুন দান ফ্লোরাইড সংক্রমণ। যা দাঁত ও হাড়কে জর্জরিত করে ছাড়ছে। এর আগে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের অনেক জায়গাতেও আর্সেনিকের সাথে ফ্লোরাইড সংক্রমণের ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে। বলা বাহুল্য যে, আর্সেনিক ও ফ্লোরাইড সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে একমাত্র চিকিৎসা: এই বিষযুক্ত জল পান করা। অর্থাৎ মাটির গভীরের জল ব্যবহার বন্ধ করা। কোথায় যাবেন আক্রান্ত মানুষগুলো?

 

উন্নয়ন ও নগরায়ন পরিকল্পনার হাত ধরে বাড়ছে জলের সংকট, জলের দূষণ সহ সামগ্রিকভাবে প্রাণ প্রকৃতির বিপর্যয়। সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানব শরীরে রোগ অসুখের প্রকোপ। 

এর শেষ কোথায়? সভ্যতা নিশ্চিহ্ন না হওয়া পর্যন্ত কর্পোরেট বাহিনী ও উন্নয়নবাবুরা কি থমকাবেন না? সব গিলে খাওয়া তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্পকে চ্যালেঞ্জ করতে না পারলে সভ্যতা কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা।

[আমাদের দেশের ফ্লোরাইড দূষণের বর্তমান চিত্র]

বিকল্প ভাবনা কি কিছু নেই? ভূগর্ভস্থ জলের উত্তোলন বন্ধ করে আমরা যেসব বিষয়গুলো ভাবতে পারি:

১। কর্পোরেটের রাসায়নিক চাষের পরিবর্তে জৈব চাষ, মিশ্র চাষ সহ প্রাকৃতিক চাষের জন্য দেশজোড়া একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা রূপায়ণ করা।

২। কোল্ড ড্রিংকসের ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। বোতল বন্দী জল নয়, পাবলিক প্লেসে সকলের জন্য বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে হবে।

৩। পানীয় জলের জন্য মাটির তলাকার জল ব্যবহার না করে, মাটির উপরিভাগের জল ব্যবহার করা দরকার।

৪। জল ভরো জল ধরো নীতির বাস্তব রূপায়ণ।

৫। জলাশয় ভরাট না করে জলাশয় ও গ্রামবাংলার নদীগুলোকে যথাযথ সংস্কার করে চাষের জল ও পানীয় জলের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে।

এই পন্থা গ্রহণ ও কার্যকরী বিকল্প ভাবনায় জারিত হতে না পারলে শেষের সেই দিনের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।

 

[পাঠকের প্রতি বিশেষ অনুরোধ লেখাটি পড়ে অবশ্যই মূল্যবান মতামত কমেন্ট বক্সে দেবেন ।]

—————–‐————————————————-

প্রতিবেদনে সন্তোষ সেন।

লেখক পরিচিতি:

বিজ্ঞান শিক্ষক, বিজ্ঞান ও পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক।

ইমেল আইডি: santoshsen66@gmail.com

তথ্যসূত্র: এই সময় পত্রিকা, ১২ আগষ্ট, ২০২৪।


Spread the love

Leave a Comment