Posted on: August 7, 2024 Posted by: Editor Desk Comments: 0
Spread the love

এনডিএ সরকার তৃতীয়বার দিল্লির মসনদে বসার পর বিগত ২৩ জুলাই ভারতের মাননীয়া অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন চলতি অর্থবর্ষের (২০২৪-২৫) জন্য প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেট সংসদে পেশ করেন। বাজেটে নির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে নানান খাতে ব্যয়ের জন্য অর্থবরাদ্দ করা হয়েছে। বর্তমান আলোচনায় আমরা মিত পরিসরে দেখার চেষ্টা করব পরিবেশ রক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার আগামী দিনে কী কী লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কী কী কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন এবং তার জন্য বরাদ্দ অর্থের পরিমাণই বা কত। আলোচনার সুবিধার জন্য কয়েকটি বিষয় ধরে এগোনো হল।

 নদীসংযুক্তি

কেন্দ্রীয় সরকার এযাবৎ দেশে ৩০টি ‘সংযুক্তি প্রকল্প’ চিহ্নিত করলেও মাত্র একটি (মধ্যপ্রদেশ-এ ‘কেন-বেতোয়া সংযুক্তি প্রকল্প’) ২০১৯ সালে সরকারের সবুজ সংকেত পেয়েছে। এবারের বাজেটে বিহার রাজ্যে কোশি (বিহারের দুঃখ)-মেচি (মহানন্দা-র উপনদী) দ্বিতীয় ‘সংযুক্তি প্রকল্প’-এর শুরু হতে চলেছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং ২,১৪,০০০ হেক্টর জমিতে সেচের কাজে কোশি-র অতিরিক্ত জল মেচি নদীতে পাঠানো হবে। এতে নেপাল থেকে ছাড়া জলে বর্ষায় প্রায়শই বানভাসি বিহারের হিমাঞ্চল অঞ্চল রেহাই পাবে। রক্ষা পাবে কয়েক লক্ষ মানুষ ও গবাদি পশুর প্রাণ, ফসল ও সম্পত্তি। বাজেটে ৭৬.২ কিলোমিটার দীর্ঘ ক্যানাল নির্মাণ করে এই সংযুক্তি প্রকল্পের জন্য ৪৯০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে।

জনগণের এই বিপুল টাকা খরচ করে এই সংযুক্তি প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশকর্মিরা প্রশ্ন তুলেছেন যে, কীভাবে এই নদীসংযুক্তি ফি-বছর বন্যা রোধ করবে এবং কৃষিখেতে এর জলসেচের কার্যকারিতাই বা কী হবে, সে নিয়ে বাজেটে পরিষ্কার কিছু বলা নেই। এখানে উল্লেখের, দেশের মোট বানভাসি অঞ্চলের ১৭.২ শতাংশ বিহারে (মোট ৯৪,১০,০০০ হেক্টর), যার মোট ৩৮টি জেলার ২৮টি বন্যাপ্রবণ।

 ক্লাইমেট ফিনান্স ট্যাক্সোনমি

বাজেট-ভাষণে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, কেন্দ্র সরকার জলবায়ু কর্মসূচির লগ্নিতে উৎসাহদানে ‘ট্যাক্সোনমি ফর ক্লাইমেট ফিনান্স’ শুরু করছে। পরবর্তী প্রজন্মের সংস্কার হিসেবে এটি স্বাধীন ভারতীয় বাজেটে এক নতুন শব্দবন্ধ। পরিবেশ রক্ষার জন্য, জলবায়ু কর্মসূচি ছাড়াও, দেশের জলবায়ু সংক্রান্ত অঙ্গীকার সম্পন্ন করতে এবং সবুজ অর্থনীতির উদ্দেশে এক বৃহত্তর পরিকল্পিত লক্ষ্যে এই উদ্যোগ। এর কিছু নির্দিষ্ট নিয়মাবলি থাকবে যা মেনে লগ্নিকারী সংস্থা ও নানান কোম্পানিকে কাজ করতে হবে। পরিবেশ রক্ষার জন্য উদ্যোগপতিদের এক তহবিল গড়তে হবে।

বিশেষজ্ঞরা মোটের উপর এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানালেও একটি প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে যে, ২০৩০ সালে আগামী ছয় বছরের মধ্যে প্যারিস চুক্তিতে সহমত হওয়া দেশের কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বর্তমান অবস্থা থেকে ২৮-৪২ শতাংশ কমিয়ে এই শতাব্দে গড় বিশ্ব উষ্ণায়নকে ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে আটকে রাখা সম্ভব হবে তো এই পরিকল্পনায়?

 পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারে জোর

কেন্দ্রীয় বাজেটে এবার অপ্রচলিত শক্তি ব্যবহারের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এইজন্য কেন্দ্রীয় নতুন এবং অপ্রচলিত শক্তি মন্ত্রক চলতি অর্থবর্ষে বরাদ্দ হিসেবে ১৯,১০০ কোটি টাকা পেয়েছে, যা গত অর্থবর্ষের তুলনায় ১১,২৫২ কোটি টাকা বেশি। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট-ভাষণে ‘বিকশিত ভারত’-এর শক্তিসুরক্ষা ও শক্তি-জোগানে অপ্রচলিত শক্তির এক অন্যতম উৎস পারমাণবিক বিদ্যুৎ বা শক্তি এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেবে বলে আশা করেছেন। এই লক্ষ্যে নিরাপদ ও সাশ্রয়কারী স্মল মডিউলার রিঅ্যাক্টর (এসএমআর) তৈরির জন্য সরকারের এই প্রচেষ্টায় বেসরকারি ক্ষেত্রের হাত ধরা হবে। নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর-এর ছোট সংস্করণ এসএমআর। কারখানায় এগুলিকে বৃহদায়তনে উৎপাদন করা সম্ভব। প্রতিটি এসএমআর ইউনিট ৩০০ মেগাওয়াট অব্দি বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম। রাশিয়া প্রথম ২০২০ সালে বাণিজ্যিক এসএমআর চালু করে।

এসএমআর নিয়ে দুটি সঙ্গত প্রশ্ন আছে। প্রথমত, বলা হচ্ছে যে এটি খরচ সাশ্রয়কারী, কম মূলধন লগ্নির প্রয়োজন। কিন্তু এমন কোন চালু এসএমআর থেকে এখনও খরচ সাশ্রয়কারী সুবিধার কথা জানা যায়নি। বরং ইউনিয়ন অফ কনসার্নড সায়েন্টিস্টস্-এর নিউক্লিয়ার পাওয়ার সেফটি-র অধিকর্তা এডুইন লিম্যান জানাচ্ছেন, পাঁচটি ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এসএমআর বানাতে যা খরচ, একটি ১০০০ মেগাওয়াট নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর বানাতে তার চেয়ে খরচ কম।

দ্বিতীয়ত, প্রথাগত নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর-এর থেকে এসএমআর যে বেশি নিরাপদ, এ নিয়েও বিশেষজ্ঞরা বেশ ধন্দে। প্রসিডিংস অফ দ্য ন্যাশনাল আকাদেমি অফ সায়েন্সেস-এর এক সমীক্ষায় (২০২২) বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছিলেন যে, এসএমআর চলতি নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের থেকে বেশি পরিমাণে রাসায়নিক এবং ভৌত তেজস্ক্রিয় বর্জ্য সৃষ্টি করে। ফুকুশিমা ও চেরনোবিল-এ আমরা দেখেছি, অসাবধানতায় এই তেজস্ক্রিয় বর্জ্যগুলি পরিবেশে মিশলে কী ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে। আর এখানেই প্রশ্ন উঠছে, পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের মতো এক বিপজ্জনক প্রযুক্তিতে বেসরকারি ক্ষেত্রকে, যাদের প্রধান লক্ষ্য যেনতেনপ্রকারেণ মুনাফা বাড়ানো, ডেকে আনা কতটা যুক্তিযুক্ত। মনে রাখতে হবে, ভারতের বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনে পারমাণবিক শক্তির অংশ কখনোই ৩ শতাংশের বেশি হয়নি। ভবিষ্যতেও এর খুব বেশি বৃদ্ধির আশা কম।

 জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ

কেন্দ্রীয় বাজেটে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য গত অর্থবর্ষের তুলনায় এই অর্থবর্ষে ২ কোটি টাকা কমে ৫ কোটি টাকা হয়েছে। বন্যপ্রাণীদের বাসভূমি উন্নয়নের খাতে গত অর্থবর্ষের ২৩৯.৬০ কোটি টাকা বেড়ে এই অর্থবর্ষে ২৯০ কোটি টাকা ধার্য হয়েছে। জাতীয় জীববৈচিত্র্য কর্তৃপক্ষের জন্য গত অর্থবর্ষের বরাদ্দ ১৬.৪ কোটি টাকা এবার কমে হয়েছে ১৬ কোটি টাকা।

 

পরিবেশ, বন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক, যে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের বিষয়টি দেখে, চলতি অর্থবর্ষে তার জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৩৩৩০.৩৭ কোটি টাকা। গত অর্থবর্ষের তুলনায় ৯৩.২৫ কোটি টাকা বেশি। জাতীয় বাঘ সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে পেয়েছিল ১১ কোটি টাকা। এবার তা বেড়ে হয়েছে ৩৫ কোটি টাকা। লক্ষণীয়, সামগ্রিকভাবে প্রজাতি সংরক্ষণে কোন টাকা বরাদ্দ হল না। পরিবর্তে বিশেষ একটি প্রজাতি সংরক্ষণের জন্য তা করা হল। যদিও মন্ট্রিল-এ সিওপি১৫ সম্মেলনে (ডিসেম্বর, ২০২২) সমস্ত প্রজাতি সংরক্ষণে সায় দেওয়া হয়েছিল।

প্রাকৃতিক সম্পদ ও বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণে বিগত অর্থবর্ষে বরাদ্দ ছিল ৪৭ কোটি টাকা। চলতি অর্থবর্ষে তা কমে হয়েছে ৪৩.৫০ কোটি টাকা। বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণে অর্থবরাদ্দ ৩৮.৪ কোটি টাকা থেকে কমে এই অর্থবর্ষে ৩৫.৫ কোটি টাকা হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, বন্যপ্রাণ অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ব্যুরো-র বাজেট-বরাদ্দ বিগত অর্থবর্ষের ১২.৩৫ কোটি টাকা যৎসামান্য বেড়ে চলতি অর্থবর্ষে ১৩.৫০ কোটি টাকা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে বন্যপ্রাণীর চোরাশিকার ও চোরাচালান থামানো যাচ্ছে না, সেখানে এই স্বল্প বরাদ্দ দিয়ে কীভাবে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ হবে, তা পরিষ্কার নয়। জাতীয় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের জন্য বরাদ্দ টাকা গত অর্থবর্ষের নয় ৯.৯ কোটি থেকে বেড়ে চলতি অর্থবর্ষে ১২ কোটি হয়েছে।

উল্লেখযোগ্যভাবে অর্থ বরাদ্দ বেড়েছে ন্যাশনাল মিশন ফর আ গ্রিন ইন্ডিয়া-র জন্য। বিগত অর্থবর্ষের তুলনায় ৫০ কোটি টাকা বেড়ে এ অর্থবর্ষে বরাদ্দের পরিমাণ ১৭০ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষের তুলনায় দ্য গ্রিন ইন্ডিয়া মিশন-এর ন্যাশনাল অ্যাফরেস্টেশন প্রোগ্রাম-এর চলতি অর্থবর্ষের বাজেট বরাদ্দ ১১৯.৪৩ কোটি থেকে বেড়ে ১৭০ কোটি টাকা হয়েছে। কাউন্সিল অফ ফরেস্ট্রি রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন-এর বিগত অর্থবর্ষের বরাদ্দ ৪৮৩.২৩ কোটি টাকা থেকে কমে এই অর্থবর্ষে ৩০০ কোটি টাকা হয়েছে। একইভাবে, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট-এর বিগত বরাদ্দ ১৭.২৫ কোটি টাকা থেকে কমে এই অর্থবর্ষে ১৩ কোটি টাকা হয়েছে। পাখি নিয়ে গবেষণাকারী সংস্থা সালিম আলি সেন্টার ফর অরনিথোলজি অ্যান্ড ন্যাচারাল হিস্টরি ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ৯ কোটি টাকা পেলেও এই অর্থবর্ষে কোন বরাদ্দ পায়নি।

 পরিবেশ উন্নয়নে রাজ্যের জন্য বরাদ্দ

রাজ্য সরকারগুলির পরিবেশ উন্নয়নে আর্থিক সহায়তার জন্য গত অর্থবর্ষের বরাদ্দ ৪৩০.৪৮ কোটি টাকা বাড়িয়ে চলতি অর্থবর্ষে ৫৭৬.৫৮ কোটি টাকা করা হয়েছে। একইভাবে, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির বেলায় এটি ১.৫ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১৪ কোটি টাকা হয়েছে। রাজ্য সরকারগুলিকে অর্থসাহায্য করার জন্য কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী এক নতুন শব্দবন্ধ মাল্টিল্যাটারাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স (এমডিএ) ব্যবহার করেছেন। রাজ্য সরকারগুলি মাল্টিল্যাটারাল ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক (এমডিবি) থেকে এই সাহায্য পাবে। উল্লেখ্য, এমডিবি থেকে নেওয়া ঋণ বা সাহায্য বাজেটের নথিতে উল্লিখিত থাকে না।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কবলে পড়া ভারতের তিন রাজ্য হিমাচল প্রদেশ (বন্যা), উত্তরাখণ্ড (মেঘভাঙা বৃষ্টি ও ধস) এবং সিকিম (বন্যা ও ধস) এই এমডিএ পাবে। এখানে অবশ্যই বলা দরকার যে, বারবার রাজ্য সরকারের তরফ থেকে আর্জি জানালেও আর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয় গঙ্গার ভাঙনে তলিয়ে যাওয়া পশ্চিমবঙ্গে মুর্শিদাবাদের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জমিজমা-সম্পত্তি রক্ষার জন্য কোন এমডিএ-র বন্দোবস্ত হয়নি। অর্থমন্ত্রীর চলতি বছরের বাজেট-ভাষণ একটু মন দিয়ে লক্ষ করলে বিহার ও অন্ধ্রপ্রদেশকেও এই সাহায্যদানের উল্লেখ নজরে আসে। অন্ধ্রপ্রদেশকে ১৫,০০০ কোটি টাকার বিশেষ আর্থিক সাহায্যদানের কথা হয়েছে। এখানেই প্রশ্ন উঠছে, এই সাহায্য কি মিলিজুলি দুর্বল এনডিএ সরকার টিকিয়ে রাখার তাগিদে? দেশের ১০০টি বড় শহর তাদের জল সরবরাহ, বর্জ্য শোধন এবং কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য এমডিবি-র সহায়তা পাবে বলে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন।

 দূষণ নিয়ন্ত্রণ

কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ-এর জন্য বিগত অর্থবর্ষে বরাদ্দ ১০৫.৭০ কোটি টাকা চলতি অর্থবর্ষে বেড়ে ১১৩ কোটি টাকা হয়েছে। বিগত অর্থবর্ষের তুলনায় দেশের দূষণ নিয়ন্ত্রণে চলতি অর্থবর্ষে বরাদ্দ সামান্য বাড়িয়ে ৮৪৭ কোটি থেকে ৮৫৮.৫০ কোটি টাকা করা হয়েছে। বাতাসের গুণমান ব্যবস্থাপনা কমিশন-এর টাকাও চলতি অর্থবর্ষে ১৩.১০ কোটি থেকে বেড়ে ১৬ কোটি টাকা হয়েছে। এখানে বলার, ভোপাল গ্যাস বিপর্যয়জনিত বিষয়ে চলতি অর্থবর্ষে কোনও বরাদ্দ হয়নি, যদিও বিগত অর্থবর্ষে এজন্য ১২৬.০৯ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল।

 মোটের উপর কী প্রাপ্তি

ওপরের মিতায়তন আলোচনায় আমরা দেখলাম পরিবেশ রক্ষা নিয়ে এবারের কেন্দ্রীয় বাজেটে কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগের ফলাফল কী তা ভবিষ্যৎই বলবে। এই মুহূর্তে কয়েকটি কথা এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, ভারতের নদীগুলি মৃতপ্রায়। এমন নদী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যেটি দূষণে আক্রান্ত নয়। চলতি বাজেটে এই নদীগুলিকে দূষণমুক্ত করে সেগুলির পুনরুজ্জীবনের বিষয়ে কিছু বলা হল না। অথচ কে না জানে এই নদীই ভারতের জীবনরেখা! আমাদের কৃষি ও শিল্প দাঁড়িয়ে রয়েছে এই নদীজলের উপর। মানুষ সহ অন্যান্য প্রাণীর জীবনধারণের প্রয়োজনীয় মিঠাজল মেলে এই নদী থেকে।

ভারতের প্রায় সর্বত্র যেভাবে বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে, বিশেষ করে উন্নয়নের নামে, যেভাবে ক্রমাগত জলাভূমি বোজানো হচ্ছে, কীভাবে এগুলো রোখা যাবে, তা নিয়েও স্পষ্ট কোন দিশা বর্তমান বাজেটে সাধারণ মানুষ দেখতে পেল না। উপরন্তু বনভূমি ও তার ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত গবেষণাকারী সংস্থাগুলির বরাদ্দ কমানো হল। প্রাকৃতিক সম্পদ ও বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ এবং জলজ বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণে বিগত অর্থবর্ষের বরাদ্দেও কোপ পড়ল। ভারতের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ন্যায্য বন্টন নিয়েও বাজেট চুপ।

আর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নানান বর্জ্যজাত দূষণ। ভারতে পৌরসভা ও পৌরনিগমগুলিতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রচেষ্টা থাকলেও পঞ্চায়েত অঞ্চলে তা না থাকারই মতো। অথচ বিগত অর্থবর্ষের তুলনায় চলতি অর্থবর্ষে দূষণ নিয়ন্ত্রণে বরাদ্দ বৃদ্ধি মাত্র ১১.৫ কোটি টাকা। এই সামান্য বৃদ্ধিতে এত বড় এই দেশে কীভাবে সুচারু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্ভব, তা বোধগম্য হল না। প্লাস্টিক দূষণ নিয়েও আশ্চর্যজনকভাবে অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট-ভাষণে মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটা কথা বলতেই হবে, যা না বললেই নয়। ইদানিং পৌরসংস্থাগুলি থেকে গাড়ি নিয়ে বেশ কিছু মানুষ আসছে বাড়ি থেকে পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য নেবার জন্য। এই উদ্যোগ অতি অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু এদের বাইরেও বেশ কিছু পুরুষ, মহিলা ও শিশু আছে, যারা আমাদের ফেলে দেওয়া বর্জ্য সংগ্রহ করে এবং সেই বর্জ্য থেকে সম্পদ তৈরির প্রক্রিয়াকে সর্বতোভাবে সাহায্য করে। এরা প্রতিনিয়ত আমাদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায়, পরনে নোংরা জামাকাপড়, পায়ে জুতো নেই, হাতে গ্লাভস নেই, মুখে নেই কোন আচ্ছাদন। এদেরই চলতি নাম কুড়ানি। এরা প্রত্যেকেই প্রান্তিক ঘরের নেই-রাজ্যের মানুষ। সকাল থেকেই এদের দেখা মেলে আস্তাকুঁড়ে, নালা-নর্দমায়। রাস্তা থেকে এরা কাগজ, প্লাস্টিক, শিশি-বোতল সহ নানা ভাঙাচোরা জিনিস সংগ্রহ করে ঝোলায় ভরে। দিনান্তে এগুলো নিয়ে ওরা বিভিন্ন বর্জ্য সংগ্রহকারী ব্যক্তি বা সংস্থার কাছে গিয়ে যৎসামান্য অর্থে সংগৃহীত বর্জ্য বিক্রি করে। এই কুড়ানিদের একটা বড় অংশ মহিলা বা শিশু যাদের দুবেলা পেটপুরে খাবার জোটানোই বড় দায়। সমগ্র ভারতবর্ষে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা তথা শহর পরিষ্কার রাখার ক্ষেত্রে এই কুড়ানিদের অবদান এক অনুচ্চারিত সত্য। দেশের নানা অংশে ‘সবুজ শহর’ পরিকল্পনা আরম্ভ হয়েছে, যার অন্যতম উদ্দেশ্য শহরকে পরিবেশ-বান্ধব করে তোলা। শহরকে পরিবেশ-বান্ধব করতে গেলে কঠিন বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত আবশ্যিক এবং এই আবশ্যিক কাজটির ক্ষেত্রে কুড়ানিদের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় কুড়ানিদের ভাবনা ব্রাত্যই থেকে গেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় বা রাজ্য বাজেটে এরা উপেক্ষিত। অথচ এরাই আমাদের সমাজের ভ্যাকুয়াম ক্লিনার। শহরকে জঞ্জালমুক্ত করে এরা দূষণ কমায়। ফলে রোগবালাই থেকে মুক্তি মেলে। কিন্তু এদের উন্নয়নের কথা আজও বাজেটে অনুচ্চারিতই থেকে গেল। 

পরিশেষে ট্যাক্সোনমি ফর ক্লাইমেট ফিনান্স নিয়ে বলার যে চিন, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা-য় এটি আগেই হাতে নেওয়া হয়েছে। আমরা শুরু করতে চলেছি দেরিতে। তাই পরিকল্পিত পথে যথাযথ চলতে না পারলে সাত মণ তেলই পুড়বে, রাধা নাচবে না।

 

[পাঠকের প্রতি বিশেষ অনুরোধ লেখাটি পড়ে অবশ্যই মূল্যবান মতামত কমেন্ট বক্সে দেবেন ।]

ছবি সৌজন্য: গুগল 

————————————————————–

লেখক : বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়, সমাজ ও পরিবেশকর্মী,

চলভাষ- ৮৪২০৫২৯৯৬৬,

ই-মেল: biswajit.envlaw@gmail.com

এবং

রাহুল রায়, পরিবেশকর্মী,

চলভাষ- ৯৪৩৩৫৭৫৩৬৪,

ই-মেল: rayrahul2263@yahoo.co.in

 


Spread the love

Leave a Comment