
৬ আগস্ট হিরোশিমা দিবস ৷ ৭৫ বছর আগের সেই অভিশপ্ত দিনের অভিজ্ঞতা শুনিয়েছিলেন জাপানী গৃৃহবধূ, ফুতাবা কিতায়ামা ৷ তখন তাঁর তেত্রিশ বছর বয়স ৷
********************
যখন নরক নেমে এলো
********************
(ফুতাবা কিতায়ামা)
কে যেন চিৎকার করে বলল, ‘একটা প্যারাস্যুট নেমে আসছে’৷ যেদিকে দেখাল সেদিকেই তাকালাম৷ সেই মুহুর্তেই আমার মুখোমুখি আকাশ হঠাৎ জ্বলে উঠল৷ কিভাবে সেই আলোর বর্ণনা করব জানি না৷ অবাক হয়ে ভাবলাম আমার চোখে আগুন জ্বলছে না তো!
বিস্ফোরণের শব্দ না আলোর ঝলক, কোনটা যে প্রথম ঘটেছিল মনে নেই ৷ শব্দের গর্জন যেন একেবারে আমার পেটে গিয়ে থামলো ৷ পরের মুহুর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম ৷ মাথা ও কাঁধের চারপাশে জিনিসপত্র ঝরে পড়তে লাগলো ৷ কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না ৷ চারদিকে ঘন কালো অন্ধকার ৷ কোনোরকমে হামাগুড়ি দিয়ে সেই ধ্বংসস্তুপ থেকে বেরিয়ে এলাম ৷
কিছুক্ষণের মধ্যে বাতাসে বিভৎস গন্ধ টের পেলাম ৷ তারপর, আমার মুখের চামড়া খুলে আসছে দেখে ঘাবড়ে গেলাম হাত ও বাহুর চামড়াও উঠে এল ৷ ডানহাতের কনুই থেকে আঙ্গুলের ডগা পর্যন্ত সমস্ত চামড়াও খুলে এল ৷
মুহূর্তখানেক আগেও যা ছিল খুবই স্বচ্ছ নীল, সেই আকাশের এ কি হল ? তখন সন্ধ্যার মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন ৷ পাগলের মতো লাফিয়ে ভগ্নাবশেষের স্তুপ পেরিয়ে সেতুর দিকে ছুটলাম ৷
সেতুর নিচে যা দেখলাম তা মর্মান্তিক ৷ শ’য়ে শ’য়ে মানুষের স্রোত ঠেলাঠেলি করতে করতে এগোচ্ছে ৷ তারা পুরুষ না নারী বলতে পারব না ৷ সবাইকে দেখতে একইরকম ৷ ধূসর ফোলা ফোলা মুখ, খাড়া খাড়া চুল ৷ দু’হাত উপরে তুলে কাতরাতে কাতরাতে ছুটছে নদীর দিকে ৷ আমারও ওইরকম অবস্থা ৷ প্রচন্ড তাপে সারা শরীরে যন্ত্রণা, প্যান্ট পুড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে ৷ যন্ত্রনায় নদীতে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিলাম ৷ হঠাৎ মনে পড়ল সাঁতার তো জানি না ! ধীরে ধীরে সেতু পর্যন্ত উঠে এলাম ৷ দেখি স্কুলের মেয়েরা স্বপ্নাবিষ্টের মতো এলোমেলো হেঁটে বেড়াচ্ছে ৷ সেতু পেরোবার সময় পিছনে তাকিয়ে দেখি, তাকেয়াচো হাতচোবেড়ি অঞ্চল হঠাৎ দাউদাউ করে জ্বলে উঠল ৷ ভেবেছিলাম, বোমায় শুধু আমি যেখানে ছিলাম সেই জায়গাটাই ক্ষতিগ্রস্থ ৷
পেরোনোর সময় লক্ষ্যই করিনি যে, সেতুর কংক্রিটের শক্ত রেলিং ধ্বংস হয়ে গেছে ৷ খুবই বিপজ্জনক হয়ে আছে ৷ নিচে মৃত কুকুর-বেড়ালের মতো ভাসছে অনেক মানুষের মৃতদেহ ৷ ছেঁড়া ও পোড়া কাপড়জামায় শরীর প্রায় উন্মুক্ত ৷
তীরের কাছে অগভীর জলে আকাশের দিকে মুখ করে পড়ে আছে এক নারী ৷ বুক দুটো উপড়ানো ৷ রক্ত চুইয়ে পড়ছে ৷ কি মর্মান্তিক ! অবাক হয়ে ভাবলাম ছেলেবেলায় যে নরকের কথা ঠাকুমার মুখে শুনেছি তাই বুঝি নেমে এল পৃথিবীতে ৷
কুচকাওয়াজ করা মাঠের মাঝে ঝর্ণায় যেন নিজেকে খুঁজে পেলাম ৷ সেখানে আসতে দু’ঘন্টার বেশী সময় লাগে নি ৷ আকাশের অন্ধকার কিছুটা কেটেছে ৷ তখনো সূর্য ঘন মেঘে ঢাকা ৷ বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন, একটা টিমটিমে অবস্থা ৷
আমার পোড়া ক্ষতে যন্ত্রণা শুরু হল ৷ সাধারণ পোড়ার যন্ত্রনা থেকে তা আলাদা ৷ সাধারণ পোড়ার যন্ত্রণা অসহ্য তীব্র, আমার ভোঁতা যন্ত্রণা ৷ শরীর থেকে অনেক দূরে অন্য কোনো জায়গা থেকে যেন এই যন্ত্রণা শুরু হয়েছে ৷ হাত থেকে হলুদ কষ গড়াচ্ছে ৷ ভাবলাম মুখের আকারও নিশ্চই একইরকম ভয়াবহ হয়েছে ৷ আমার চারপাশে জুনিয়র হাই স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে ৷
‘মা-মাগো’ বলে পাগলের মতো চিৎকার করছে ৷ বিচ্ছিরিভাবে পুড়ে গেছে, সারা শরীর জুড়ে এমন রক্তের স্বাক্ষর যে তাদের দিকে তাকাতে ভয় হয় ৷ তাদের জন্য সেদিন কিছুই করতে পারিনি ৷ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছি, কাতরভাবে বৃথাই মাকে ডাকতে ডাকতে একে একে কিভাবে তারা মারা গেল ৷ ক্ষয়িষ্ণু দৃষ্টি নিয়ে যতদূর দেখতে পেলাম, সবকিছু জ্বলছে ৷
ধীরে ধীরে আমার মুখ শক্ত হয়ে গেল ৷ সাবধানে গালে হাত দিয়ে মুখটাকে অনুভব করলাম ৷ দেখি রাস্তায় স্ট্রেচারে করে বহু আক্রান্ত মানুষকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ৷ পশু বয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো টানা গাড়ি ও লরিতে বোঝাই মৃত ও আহত মানুষ আমাকে পেরিয়ে যাচ্ছে ৷ রাস্তার দুই ধারে বহু মানুষ স্বপ্নাবিষ্টের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে ৷
এই অভিজ্ঞতা ও মানবতার চুড়ান্ত অপমান যেন পৃথিবীতে আর ফিরে না আসে ৷
[পাঠকের প্রতি বিশেষ অনুরোধ লেখাটি পড়ে অবশ্যই মূল্যবান মতামত কমেন্ট বক্সে দেবেন ।]
‐—————————————————
লেখক : ড.অমিতাভ চক্রবর্তী