
মূলত একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাস নিয়ে থাকি। সঙ্গে অন্য কিছু ক্লাস। তার মধ্যে একটি পঞ্চম শ্রেণির গণিত। ভালোলাগার একটি ক্লাস। ওদের হাসি, ওদের কথায় এক চুম্বকীয় টান অনুভব করি। একদিন না আসলে ওদের হাজারো প্ৰশ্ন। কেন এলাম না? আমার কী হয়েছিল? মা-বাবা ও পরিবারের পরে কেউ কি এত করে ভেবেছে? জানি না! আর এখন তো সব কিছুকে ছাপিয়ে গেল। ছোট ছোট নিষ্পাপ শিশুরা রোজ তাদের বাগান থেকে একটি করে ফুল নিয়ে আসে।
আর সেই ফুল হাসিমুখে হাতে তুলে দেয়। এই ফুল দেওয়ার পর ওদের তৃপ্তির হাসি পার্থিব সব দুঃখ মুহূর্তেই ভুলিয়ে দেয়। হাসিমুখে গ্রহণ করি। ওদের সৎ ও পবিত্র হৃদয় থেকে দেওয়া এই ভালোবাসার উপহার অস্বীকার করার মতো ক্ষমতা আমার মতো সামান্য একজন মানুষের নেই। একদিন ওদের জিজ্ঞেস করেছিলাম- “তোমরা যে রোজ ফুল নিয়ে আসো তোমাদের কষ্ট হয় না?” ওরা উত্তর দিয়েছিল- “না স্যার। আমাদের একটুকুও কষ্ট হয় না।” জিজ্ঞেস করেছিলাম- “তোমাদের ফুল যদি আমি গ্রহণ না করি তোমরা কী করবে?” উত্তরে বলেছিল -“স্যার। আমরা অনেক কষ্ট পাব। আপনি নেবেন।” বেলি, করবী, গন্ধরাজ, টাইম ফুল, টগর, নয়নতারা, রঙ্গন ও আরও কিছু ফুল। কিছু আমারও অচেনা। তবে অবাক হই ওদের দেওয়া সব ফুলগুলোই সাদা। শুধুমাত্র দু’দিন দু’টি রঙিন ফুল দিয়েছিল। হয়তো সাদা ফুলগুলোই ওদের বাগানে ফোটে নয়তো ওদের সৎ ও পবিত্র হৃদয়ের চিহ্ন বহন করে। প্রতিষ্ঠিত করে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কই পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র ও শান্তির সম্পর্ক।
রোজ উপহার হিসেবে পাওয়া সুগন্ধী ফুলগুলো আমার এই চোদ্দ বছরের শিক্ষকতা জীবনের সেরা উপহার। জানি ওরা যে সম্মান ও ভালোবাসা দেয় তার প্রতিদান দেওয়া সম্ভব নয়। বিনিময়ে কিছুই দিতে পারি না। কবিগুরুর কথায় – “অনেকদিন ছিলাম প্রতিবেশী,/ দিয়েছি যত নিয়েছি তার বেশি।” অনেকটা স্বার্থপরের মতো। ভয় হয় ওদের ভালোবাসা ও সম্মানের মর্যাদা যদি রাখতে না পারি। এই ভয় ভাবতে বাধ্য করে। রোজ শিক্ষক হিসেবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওদের কাছে অনেক কিছু শিখে বিকেলে ছাত্র হিসেবে বাড়ি ফিরি। রোজ নিজেকে নতুন করে তৈরি করি।
চারপাশে মিথ্যে ও অসৎ ভালোবাসায় ভরে উঠছে সমাজ। কথা দিয়ে কথা না রাখা ও বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়ে উঠছে এক শিল্প। অভিনয়ে প্রায় প্রত্যেকেই অস্কার জয়ী। সেখানে ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকার মধ্যে এই সম্পর্ক মরুর বুকে হিমালয়ের শান্ত বাতাসের মতো। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও পবিত্র সম্পর্ক।
আর এটাই তো স্বাভাবিক। এরকমটাই তো হওয়া উচিত। আর এই সম্পর্কের মাঝে যখন কালো মেঘের গর্জন শুনি, শিক্ষকদের নামে আঁধার ঘনিয়ে আসার গল্প শুনি তখন কষ্ট হয়। তিরবিদ্ধ হওয়ার যন্ত্রণা অনুভব করি। কিছুতেই মানতে পারি না। খুব ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল শিক্ষক হওয়ার। ভালোবেসে এই শিক্ষকতা বেছে নেওয়া। একটাই চাওয়া পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পর্ক এই ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকা সম্পর্ক আরো সুন্দর হোক। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দেখানো পথে বিজয় মশাল নিয়ে প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীরা এগিয়ে যাক সাফল্যের শিখরে। আর নিশ্চিত সেদিন এই দুইয়ের যৌথ বন্ধনে আঁধার সরিয়ে আলো ফিরবে। তারায় ভরবে আকাশ। সেই আকাশের নিচে বেড়ে উঠবে এরকম হাজারো ফুল। আর সেদিন আমরা সবাই বলব পৃথিবী সুন্দর। সত্যি সুন্দর।
(নিষ্পাপ হাসিমুখ ও স্মৃতি হিসেবে ধরে রাখা কয়েকটি ফুলের ছবি নিচে যুক্ত করলাম।)
🖊️ সঞ্জয় মল্লিক
০২.০৮.২৪
কোচবিহার
[পাঠকের প্রতি বিশেষ অনুরোধ লেখাটি পড়ে অবশ্যই মূল্যবান মতামত কমেন্ট বক্সে দেবেন ।]