
স্মরণে প্রয়াত আশীষ মুখার্জী
ফেসবুকের মাধ্যমেই খবর পাওয়া গেল আশীষবাবু প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর সঙ্গে কবে কিভাবে প্রথম পরিচয় হয়েছিল তা আজ আর মনে নেই। তবে আমাদের নানা অনুষ্ঠানে তিনি প্রায়ই আসতেন এবং আমি অন্তত বারদুয়েক কোন না কোন কাজে ওনার বাড়ি গিয়েছি তা পরিষ্কার মনে আছে। উনি জাহাজে কাজ করতেন এবং ওনার লেখা দুটি বই আমাকে উপহারস্বরূপ দিয়েছিলেন। তবে ঘটনা যাই হোক না কেন আমাদের সকলের যোগসূত্র ছিলেন একজনই — আর সেটা আর কেউ নয় আমাদের জ্যোতির্বিজ্ঞানের মাষ্টারমশাই ড. রমাতোষ সরকার। তাঁর জীবৎকালেই আমরা জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চায় মেতে উঠেছিলাম ও নানা মহাকাশীয় ঘটনায় অংশগ্রহণ করা শুরু করেছিলাম।
আমার কাছে থাকা যে সব কাগজপত্র এতদিন ধরে সযত্নে রক্ষিত আছে তা থেকে দেখা যাচ্ছে কলকাতায় অধ্যাপক নারায়ণচন্দ্র রাণার অকালমৃত্যুর পর প্রথম স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রধানত আশীষবাবুর উদ্যোগে। দিনটি ছিল ২৭ আগস্ট ১৯৯৭ বিকাল ৫ টায়।
বিষয় — Social and Technical Aspects of Late Prof. Narayan Chandra Rana
এই উপলক্ষে এক পুস্তিকায় দু’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখা ছিল। তার একটি আশীষবাবুর লেখা যার শিরোনাম
ছিল — “নারায়ণ চন্দ্র রানার সঙ্গে শেষ দশ বছর” — এই লেখায় আশীষবাবু ১৯৮১ সালে তাঁর সাউরী গ্রামে যাওয়া, পরে ১৯৮৭ সালে অধ্যাপক রানার বোম্বাইএর কোয়ার্টারে গিয়ে তাঁর সংগ্রহে থাকা ১০” টেলিস্কোপটি কিভাবে ট্রেনে বুক করে খড়্গপুরে নামিয়ে সাউরী গ্রামে অধ্যাপক রানার মাষ্টারমশাই মনীন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ী মশায়ের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন তার চমৎকার বিবরণ দিয়েছেন। ১৯৯১ সালে মণিবাবুর মৃত্যুর দু’বছর পর তৈরি হয় তাঁর নামে এক এসট্রোনমিক্যাল ট্রাস্ট। ১৯৯৪ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজে এই ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয় চতুর্থ সারা ভারত অপেশাদার জ্যোতির্বিদ সম্মেলন যেখানে প্রায় ৪০০ জন শখের জ্যোতির্বিদ উপস্থিত ছিলেন। ঐ সম্মেলনেই গঠিত হয় “কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান এমেচার এস্ট্রোনমার্স ” — উদ্দেশ্য ছিল সারা ভারতে জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চাকে ছড়িয়ে দেওয়া। অবশ্যই এই কাজে অধ্যাপক রানার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই লেখাটিতে আশীষবাবু অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে অধ্যাপক রানার চরিত্রে নানা অসাধারণ গুণাবলীর বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন।
অপর লেখাটি লিখেছিলেন আমাদের স্যার ড. রমাতোষ সরকার — লেখার শিরোনাম ছিল ” নারায়ণ চন্দ্র রানা: স্মৃতিচারণা”। এই লেখায় স্যার অধ্যাপক রানার বেড়ে ওঠা, তাঁর জীবনে শিক্ষকদের প্রভাব প্রভৃতির পাশাপাশি তাঁর ব্যক্তিগত পড়াশোনা ও কর্মজীবন নিয়েও সংক্ষিপ্ত অথচ মনোজ্ঞ আলোচনা করেছেন। কলকাতা বইমেলায় দু’জনে একসাথে গিয়েছেন, হাতে সময় কম থাকা সত্ত্বেও কিভাবে সেই স্বল্প সময়ে অধ্যাপক রানা দু’তিনটি বই যার মধ্যে ছিল সাহিত্য সংসদ এর প্রকাশনার “বাংলা ব্যাকরণ অভিধান” সেটি কেনারও উল্লেখ করেছেন।
আশীষবাবুর উদ্যোগে কলকাতায় “S.N.Bose National Centre for Basic Sciences” এ ২০ ডিসেম্বর ১৯৯৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় সারাদিনব্যাপী এক চমৎকার সেমিনার যার শিরোনাম ছিল “Leonids 98 : A Postmortem” এই অনুষ্ঠানেই প্রথম আমার সুযোগ হয়েছিল অধ্যাপক সন্দীপকুমার চক্রবর্তীর Uncertain Universe — from Galaxy to Comets and Asteroids নামক প্রায় ৪৫ মিনিটব্যাপী অনবদ্য আলোচনা শোনার এবং ঠিক তার পর পরেই অধ্যাপক অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া “Meteors and Meteor Showers” আরেকটি অপূর্ব আলোচনা শোনার। সেদিন গোটা দিনজুড়েই ছিল মিটিওর শাওয়ার নিয়ে নানাজনের নানা অভিজ্ঞতার কথা। এই উপলক্ষে Astro — Update নামে অর্ণব রায় সম্পাদিত এক ছোট পত্রিকাও প্রকাশিত হয়েছিল।
উল্কাবর্ষণ নিয়ে আশীষবাবুর লেখা একটি লিফলেটও প্রকাশিত হয়েছিল।
১১ মে ২০০০ সালে আশীষবাবু সি.আই. আই. এ.এ নিয়ে একটি সভা আহ্বায়ক লিফলেট প্রকাশ করেন। এই লিফলেটে তিনি C.I.A.A (The Confederation of Indian Amateur Astronomers) এর প্রেসিডেন্ট হিসাবে স্পষ্ট ভাষায় লিখেছিলেন যে এই প্রতিষ্ঠান আসলে প্রায় ৫০ টি সংস্থার এক যৌথ প্রয়াস। এটির নিবন্ধীকরণ বা রেজিষ্ট্রেশন হয়েছে পুণায়, সেক্রেটারিয়েট আছে দিল্লীতে এবং কলকাতায় আছে রিজিওনাল সেন্টার।
খাস কলকাতার বুকে সি আই টি রোডে ফুলবাগানের কাছে মাণিকতলা ভি আই পি বাজারের ছাদে একটি ১০” নিউটোনিয়ান ইকুইটোরিয়াল মাউন্টেড মোটরচালিত টেলিস্কোপ বসিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে আকাশ দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য এবং সেইসঙ্গে লাইব্রেরি, কম্পিউটার সেন্টার ও স্থায়ী প্রদর্শনীর ভাবনাচিন্তা নিয়ে একটি সভা আহূত হয়েছিল ৩১ মে ২০০০ সালে বিড়লা তারামন্ডলের সভাঘরে।
যাইহোক আমাদের কোর্স শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমরা এডভান্সড কোর্স করার জন্য বি. আই. টি. এম এ আলাদা করে ভর্তি হলেও স্যারের মৃত্যুর পর তারামন্ডলে যে শোকসভা হয়েছিল সেখানে ও আমাদের পরবর্তী বেশ কিছু অনুষ্ঠানে আশীষবাবু উপস্থিত ছিলেন। সেইসময় আমাদের সঙ্গে কলকাতার আরও কিছু আকাশচর্চার প্রতিষ্ঠান যেমন স্কাই ওয়াচার্স এসোশিয়েশন, ব্রেক থ্রু সায়েন্স সোসাইটি প্রভৃতি সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হয়। স্যারের মৃত্যুর পর আমরা যে এলামণি সংগঠন তৈরি করেছিলাম ও পরে বি আই টি এম এস্ট্রোনমি ক্লাব — তার অনেক অনুষ্ঠানেই আশীষবাবু উপস্থিত ছিলেন বেশ মনে আছে। তবে আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হত উনি বরাবরই কাজের মানুষ। জাহাজে চাকরী করলেও এবং ধনাঢ্য হলেও বাইরে তার প্রকাশ কখনও দেখাতেন না। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি কলকাতা বইমেলায় (তখন বইমেলা ময়দানে হত) টেলিস্কোপ নিয়ে গিয়ে ওই ভীড়ের মধ্যেও আকাশ দেখার ব্যবস্থা করতেন। নানা কারণে ২০১৫ সালের পর থেকে আমাদের কার্যকলাপে ভাটা পড়ে যায় ও আশীষবাবুর সাথে যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
আক্ষেপ একটাই কলকাতার নানা সংস্থাকে নিয়ে লেখালেখি করলেও আশীষবাবুকে নিয়ে কোন লেখা করা হয়নি। আকাশপ্রেমী এই মানুষটির স্মৃতির প্রতি আমার অকুন্ঠ শ্রদ্ধা জানাই।
[পাঠকের প্রতি বিশেষ অনুরোধ লেখাটি পড়ে অবশ্যই মূল্যবান মতামত কমেন্ট বক্সে দেবেন ।]
——————————————————
লেখক : ড. সুকান্ত মুখার্জী, হাওড়া