Posted on: August 2, 2024 Posted by: Editor Desk Comments: 0
Spread the love

আধুনিক ওষুধের ‘জীবনকাল'(Shelf Life)

 ওষুধ কোম্পানি ও সরকারের প্রতারণা

 ——————

   প্রাক-কথন

          ওষুধের জীবনকাল কাকে বলে ? কোন ওষুধ ফর্মূলেশনের মানুফাকচারিং ডেট(উৎপাদনের তারিখ) ও এক্সপারি ডেটের(মরণের দিন) মধ্যবর্তী সময় হচ্ছে ওষুধের জীবনকাল। অর্থাৎ ফর্মূলেশন উৎপাদনের তারিখ থেকে মৃত্যুর তারিখ পর্যন্ত সময় হচ্ছে ‘সেলফ লাইফ'(Shelf Life) বা জীবনকাল।              

        একজন এমবিবিএস ছাত্র হিসেবে (১৯৭৩-১৯৭৯) সাত বছর, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য দপ্তরের মেডিকেল অফিসার হিসেবে(১৯৮৬ – ১৯৯১) সাড়ে পাঁচ বছর ও ওষুধ বিজ্ঞানের প্রশিক্ষক হিসেবে(১৯৯১- ২০২০) ঊনত্রিশ বছর আধুনিক ওষুধ বিজ্ঞানের সাথে আমার সম্পর্ক। নিজে ওষুধ প্রয়োগ করেছি, রোগীদের পরামর্শ রেখেছি ও ছাত্রদের পড়িয়েছি — ‘মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ’ ব্যবহার করবেন না । ওষুধ কেনার সময় ওষুধের ‘জীবনকাল'(Shelf Life) দেখে নেবেন। এই সময়কালে জনগণের কাছে প্রচার করেছি ‘মেয়াদ উত্তীর্ণ’ ওষুধ বিক্রি দণ্ডনীয় অপরাধ। ফার্মাসিস্ট বা বিক্রেতা বা চিকিৎসক ‘মেয়াদ উত্তীর্ণ’ ওষুধ রোগীদের ব্যবহার করার পরামর্শ দিলে জামিন অযোগ্য ধারায় গ্রেপ্তার হবেন।

             কিন্তু মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ, নিজ নিজ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইন কী আছে জানিনা। আমি এখন মেয়াদ উত্তীর্ণ অনেক ওষুধ ফর্মূলেশন নিজের রোগের জন্য ব্যবহার করি।

                    দেখা বিষয় গুলো

                        বুঝিনি সেদিন 

১# আজ থেকে সবাই ওষুধের মোড়ক নজর করবেন। দেখবেন ওষুধের জীবনকাল (Shelf life) স্ট্যাম্প মেরে রাখা হয়েছে।

২# ওই স্ট্যাম্প মারা অংশ সহজেই স্পিরিট দিয়ে তুলে ফেলা যায়। অন্য ছাপা লেখাগুলো মোছা যাবে না। প্রশ্ন করুন কেন এমন হলো ?

৩# আসলে বার বার স্টাম্পের সাহায্যে ওষুধ ফর্মূলেশনকে জীবন্ত রাখা হয়। আমরা আসলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘মৃত’ ওষুধ ফর্মূলেশন কিনে ব্যবহার করি।

৪# তাহলে দাঁড়াচ্ছে যে অনেক ‘মরা’ ওষুধ ফর্মূলেশনে কাজ হয়। অনেক পরীক্ষায় দেখা গেছে কোন ক্ষতি হয় না।

৫# আমি ঊনত্রিশ বছর ওষুধ বিজ্ঞানের প্রশিক্ষক (Demonstrator) হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরি করেছি ; কিন্তু এই সব প্রশ্ন আমার, ছাত্রদের বা আমাদের মনে জাগেনি। শাসকশ্রেণীর সৌভাগ্য আর আমাদের দুর্ভাগ্য !

৬# ওষুধ কোম্পানি, শাসকশ্রেণী ও এঁদের সরকার যুগ যুগ ধরে আমাদের মনকে শৃঙ্খলিত করে রেখেছিল। আমারা ওষুধ মোড়কে স্ট্যাম্প মারা ও ছাপা লেখা নিয়ে কোনদিন প্রশ্ন তুলিনি। এই প্রশ্ন তুলতেই আমার কমবেশী পঞ্চাশ বছর লেগে গেল !

                     এ গবেষণা নয় 

                 এ বৈজ্ঞানিক প্রয়োগ

        আমি মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ Amlodipine, Telmisartan ও Metformin ব্যবহার শুরু করলাম। আগে Metronidazole ও Albendazole ব্যবহার করেছি। নিজের সমস্যা গুলোর জন্য আগে ‘জীবন্ত ওষুধ’ খেতাম। এখন ‘মরা ওষুধ’ খাই। 

         এটা কোন হঠকারী, উদ্ভট, হিরো-সাজা, অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক, অনৈতিক, বেআইনী বা ভয়ঙ্কর আত্মঘাতী পরীক্ষা নয়, বরং সত্য প্রতিষ্ঠার সহজতম লড়াই। এ লড়াইয়ে প্রতি মুহূর্তের নিরাপত্তা ও বিজয়লাভ পরীক্ষা ও সঠিক পর্যবেক্ষণ দ্বারা নির্ণয় করা হয়েছে। রক্তের চিনির পরিমাণ মেপে দেখা আর রক্তচাপ নিয়ম মেনে মেপে দেখা হয়েছে। দুটো ক্ষেত্রেই সব কিছু নিয়ন্ত্রণে আছে। মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধে আমার ভালোই কাজ হয়েছে। কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করিনি।

              মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ খাওয়ার দিন যত বাড়তে থাকে আর আমার বিশ্বাস তত দৃঢ় হয়। আমি সাহসী হই। শাসকশ্রেণী, ওষুধ কোম্পানি ও সরকারের চরম প্রতারণা এখন, দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে আমাদের শ্রেণী-শাসনের কথা বলতে থাকে !

            শাসকশ্রেণীর প্রতি ঘৃণা, ওষুধ কোম্পানির প্রতি অবিশ্বাস,সংশয় ও সরকারের দ্বিচারিতার প্রতি চরম অবিশ্বাস ও বিরুদ্ধতা গড়ে তুলি। ধরে রাখি। গণপ্রচারে যাই। ওষুধ কোম্পানিরা যে মুনাফা আর পুঁজির জন্য ওষুধ বাজারে আনে–এই বিশ্বাসের প্রতিটি ভিত আরো শেকড় খুঁজে পায়। গণভিত তৈরি হয়।

             এ কাজের তত্ত্ব ও প্রয়োগের নীতি ও পদ্ধতি শাসকশ্রেণীর কাছে আমাদের শেখা। অনেকটাই সিলেবাসের বাইরের শিক্ষামালা। অথচ শাসকশ্রেণীর সরকার ও ওষুধ কোম্পানি মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ সম্পর্কে কখনো প্রকৃত তথ্য জনগণকে জানায়নি। সত্যের উপর দাঁড়িয়ে ওষুধ ব্যবহারের নিয়মাবলী রচনা করেনি।

          আজকের দিনে ওষুধ কোম্পানীদের ওষুধ গবেষণা, উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ এর চালিকা শক্তি জনমানুষের কাছে জলের মতো পরিষ্কার। বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানীর জনগণবিরোধী ভূমিকা আজ আন্তর্জাতিক পাঠ্যপুস্তকে(Goodman & Gilman এর বই) পড়ানোর বিষয় হয়ে উঠেছে। পুঁজি ও মুনাফা যে প্রধান চালিকা শক্তি তা জীবন্ত হয়ে প্রকাশ্যে এসেছে।

                  আপন মনের দ্বন্দ্ব

               তথ্য থেকে সত্য খোঁজা

           প্রাণের ভয়ে মানুষ ‘মৃত ওষুধ’ খান না । যদি রোগ না সারে বা শরীরের ক্ষতি হয়ে যায়। বিগত কমবেশী পঞ্চাশ বছর ধরে ওষুধ কোম্পানি ও সরকার জনমানুষের মনের মধ্যে এমন বিশ্বাস গড়ে তুলেছে। আমরা শিক্ষকরা এমবিবিএস ছাত্রদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। আইনের ভয় দেখিয়েছি। আসলে ওষুধবিজ্ঞানকে ‘মেরে’ই ফেলেছি।

         এখন ওষুধ কোম্পানির শ্রেণী-বন্ধুদের প্রকাশিত তথ্য থেকে জানতে পারছি —আমেরিকার ‘ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’ বলছে ‘যদি ওষুধের মোড়কে আয়ুষ্কাল দু’বছর লেখা থাকে তাহলে তা পরীক্ষা করার দরকার নেই। সব ওষুধের আয়ুষ্কাল কেন দু বছর ? বিভিন্ন ওষুধ-রাসায়নিক কী একই জীবনকালের অধিকারী ? না । আমেরিকার এফ.ডি.এ’র পরীক্ষাগারের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে “Manufacturer puts dates on for marketing, rather than for scientific reasons.”                                      

           ওষুধ খেতে খেতে মনে হতো ‘শরীরের ক্ষতি হয়ে যাবে না তো ? ওদেরই তথ্য থেকে জেনেছি ‘মৃত ওষুধ খেয়ে কাজ না হোক, ক্ষতি হবে না’। ওদের এই তথ্য আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হলো কী করে ? ওঁদের কাজ ও আচরণের দ্বিচারিতার উল্টো পথে হেঁটে সত্যের সন্ধান পেয়েছি।

                 মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ ব্যবহার কী আমার আত্মঘাতী ওষুধ প্রয়োগ বা পরীক্ষা, কোনটাই নয়। বিজ্ঞান সম্মত ভাবে আমি ওষুধ প্রয়োগ করেছি। আসলে ওষুধ কোম্পানির প্রতারণার আড়ালের সত্য জেনে গেছি। প্রতারণার বিরুদ্ধে এটাই আসল সত্য।

                A paradigm shift

              একটি মৌলিক পরিবর্তন                      

         আমরা চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করেছি। তখন বিজ্ঞান প্রয়োগের শ্রেণী-সম্পর্ক বুঝিনি। কমবেশী পঞ্চাশ বছর ধরে এক মিথ্যে শ্রেণী-নিরপেক্ষ মনোভাব নিয়ে শ্রেণী সমাজে ডাক্তারী করেছি । কত যে অপ্রয়োজনীয় ও নিষিদ্ধ ওষুধ রোগীদের লিখেছি আর মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের ব্যবসায়িক ‘প্রশংসা’ পেয়েছি তা বলে বোঝানো যাবে না ! 

              ১৯৮৬ সাল নাগাদ আমাদের ডাক্তারি জীবনে ‘ড্রাগ ডিসিজ ডক্টর’ পত্রিকা(Drug Disease Doctor ।1986) চিকিৎসা বিজ্ঞান চর্চা ও প্রয়োগের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। A paradigm shift । এ ঋণ কোন দিন শোধ হবেনা। 

        DDD পত্রিকার শিক্ষামালাই তো আমাদের ওষুধ কোম্পানির নিত্য প্রতারণার জাল ছিঁড়তে সাহায্য করেছে। বাজারের আশি শতাংশ অপ্রয়োজনীয় ওষুধকে চিনিয়ে দিয়েছে । ব্যবহার করতে নিষেধ করেছে। গণ প্রচারে সাহায্য করেছে। ওষুধ কোম্পানির ‘দালাল’ বা কমিশন ভোগী চিকিৎসক হওয়া থেকে আমাদের রক্ষা করেছে। DDDএর শিক্ষামালাকে আরো তিরিশ বছর এগিয়ে দিয়েছিল বোধি ( BODHI । Bulletin on Drugs & Health information । 1993 )পত্রিকা। 

           বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিপূর্ণ ওষুধ প্রয়োগ করতে শেখানোর দায়িত্ব এমবিবিএস সিলেবাস পালন করেনি, করেছে DDD ও BODHI পত্রিকা। ওষুধ বাজারের চরম অনাচারের বিরুদ্ধে লড়াই চলাকালে, আজ থেকে চব্বিশ বছর আগে জন্ম নিল সোসাইটি ফর সোসাল ফার্মাকোলজি(২০০০) সংগঠন। জন্ম নিল সংগঠনের মুখপত্র ‘সোসাল ফার্মাকোলজি’ বুলেটিন(সেপ্টেম্বর। ২০০২)। 

          ওষুধ বিজ্ঞানের সাথে সমাজ-বিজ্ঞান, রাজনীতি-বিজ্ঞান, অর্থ-বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম ইত্যাদির সম্পর্ক শেখা ও বোঝার জন্ম হলো, ওষুধ বিজ্ঞানে প্রথম অধ্যায় হিসেবে। যা আজও চলমান। সোসাল ফার্মাকোলজি’র তেতাল্লিশতম(৪৩) সংখ্যা (জুন ।২০২৪) প্রকাশনার পথে।

            এই সব শিক্ষামালা ও অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে ওষুধ কোম্পানীদের রোগী-প্রেমের নামে বা আড়ালে মুনাফা ও পুঁজির আকাঙ্খাপূরণের গণপ্রতারণা। 

            আমেরিকা থেকে প্রকাশিত ‘মেডিকেল লেটারস্'(Medical Letters)-এর এক তথ্য বলছে “There are virtually no reports of toxicity from degradation products of outdated drugs.”

            উত্তর চব্বিশ পরগনার জনৈক সমাজ কর্মী বললেন, আমরা সবাই আসলে মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ বা মরা ওষুধই ব্যবহার করি। ও গুলো বার বার স্ট্যাম্প মেরে টাটকা বা জীবন্ত ওষুধ ফর্মূলেশন করা হয়।

           আমি বার বার ভেবেছি, আমার মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ খেয়ে খুব ভালো থাকা কী ‘উচ্ছিষ্ট ভোগী’র জীবন। যা পাই তাই খাই ! না। সত্য অনুসন্ধানে এ খুব সহজতম পথ। কারণ সাম্রাজ্যবাদীদের পাণ্ডা আমেরিকা সরকার নিজের তার সেনাবাহিনীর জন্য বার বার স্ট্যাম্প মেরে তারিখ বদলে ‘মরা ওষুধ’কে জীবন্ত রাখে।

            ব্রিটিশ রাজের হাত ধরে ভারতের ‘ওষুধ ও প্রসাধনী আইন-১৯৪০ এর ‘অপবিত্রকরণ’ ঘটিয়ে, আমার মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ খাওয়া আজও চলমান রয়েছে।

 

 

[পাঠকের প্রতি বিশেষ অনুরোধ লেখাটি পড়ে অবশ্যই মূল্যবান মতামত কমেন্ট বক্সে দেবেন ।]

——————————————————

লেখক : স্বপন জানা। ১ আগস্ট ২০২৪। কলকাতা।

সৌজন্য : সোসাইটি ফর সোসাল ফার্মাকোলজি


Spread the love

Leave a Comment