
ছোট্ট একটা মেয়ে জানতে চায়, আকাশে স্টার হওয়া যায় কি করে!
উত্তরে থাকি মৌন।
সে শুনেছে, যে আর ফিরে আসে না সে আকাশে স্টার হয়ে যায়।
কিন্তু কেউ যদি জীবিতকালে আকাশের তারা নিয়েই থাকেন?
তেমনই এক মানুষ ‘ছিলেন’ তিনি। ছিলেনটা লিখতেই হলো কারণ তিনি ১৩ জুলাই মারা গেছেন।
মানুষটা দেখতেন আকাশ অথচ থাকতেন জলে। জাহাজে বড় পদে কাজ করতেন তিনি। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, জাহাজে কাজ মানে অঢেল অর্থ উপার্জন। তারপর “ছুটিতে যখন” তখন বিলাস বৈভবে দিন কাটানো!
কিন্তু এই মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মানুষটি ছিলেন অন্যরকম। ওঁর স্ত্রী জয়া গাংগুলি একবার গল্প করতে করতে বলেছিলেন, ওঁদের যৌথ জীবনের প্রথম পর্বে বাইরে বেরোলে হোটেল তো দূরে থাক, রেলেও রিজার্ভেশন করতেন না।অসংরক্ষিত আসনে রেল ভ্রমণের পাশে ছিল হিচ হাইকিং। এমনই বিলাসবিহীন জীবন ছিল তাঁর।
মেরিন ইঞ্জিনিয়ার তো অনেকে হন কিন্তু ক’জন এই জাহাজি জীবন, স্বাদু বাংলায় সকলের কাছে তুলে ধরতে পারেন! তিন খণ্ডে লেখা যন্ত্রবিদ জাহাজির ডায়েরি তো স্রেফ আত্মকথা নয় বরং আমাদের মত আদার ব্যাপারীদের জাহাজের খবর জানানোর সার্থক প্রয়াস।
বইয়ের বাইরে ওঁর কাছে সে-জীবনের গল্প শুনেছি। খুব ভালো লাগতো ওঁর কাছে জাহাজ কোনো বন্দরে ভেড়ার পর ওঁর সে দেশ দেখার গল্প শুনতে।
কোনো সময় জাহাজ বেশ কিছুদিনের জন্য কোনো বন্দরে থাকলে উনি সেই দেশে ঢুকে পড়তেন। থাকতেন ইউথ হোস্টেলে। ওঁর কাছেই প্রথম আন্তর্জাতিক ইউথ হোস্টেল সংস্থার কথা শুনেছিলাম। তার সদস্য হওয়া যে কত জরুরি সেকথা বলেছিলেন।
ওঁকে চিনতাম আগেই। তবে ওঁর সংগে প্রথম আলাপ এক পরিবেশের অনুষ্ঠানে। সেটা কি ১৯৯৯? আমি সেখানে বলেছিলাম পরিবেশ আর ইতিহাসের সম্পর্ক নিয়ে। নেহাতই ছোকরা সেই বক্তার সঙ্গে নিজে থেকেই আলাপ করে বলেছিলেন, “আপনি নিজের বিষয়কে বেশ ফীল করতে পারেন তো”। আগে থেকেই জানতাম উনি আকাশকে অনুভব করতে পারেন আর তখন থেকেই বুঝলাম উনি যাকে ভালো কাজ মনে করেন তাকে উৎসাহ দিতে পারেন, উৎসাহ দিতে জানেন।
কালক্রমে ‘আপনি’, ‘তুমি’ হয়ে গিয়েছিল। জ্যোতির্বিজ্ঞানের কত অনুষ্ঠানেই যে ওঁর সংগে দেখা হয়েছে! বইমেলায় দেখেছি ভীষণ ব্যস্ত। বড় দূরবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে সকলকে আকাশ দেখাচ্ছেন।
জাহাজের ডেকে শুয়ে আকাশ দেখতেন আর সেখান থেকেই আকাশ দেখানোকেই জীবনের ব্রত করলেন তিনি, আশিস মুখোপাধ্যায়।
১৯৯৩ সালের এপ্রিলে আনন্দবাজার পত্রিকার কলকাতার কড়চায় লেখা হয়েছিল ওঁকে নিয়ে। সচিত্র প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, “আকাশ দেখুন”। লেখা হয়েছিল ওঁর দূরবীন ফেরি করার গল্প। তখনকার দিনে তার দাম ছিল আটশো থেকে আট হাজার টাকা। তবে আর্থিক লাভ করা তো ওঁর উদ্দেশ্য ছিল না, ধারেও দিতে পারতেন দূরবীন। বহুদূরে ছিল তাঁর দৃষ্টি।
আমাদের দেশে অপেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চার ঐতিহ্য পুরনো। তবে সেই সব উদ্যোগ ব্যক্তিগত। সংগঠিতভাবে এই চর্চার উদ্যোগ যাঁরা নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে সামনের সারিতে থাকবেন উনি। স্কাই ওয়াচার্স আসোসিয়েশন, অনুসন্ধিৎসু… সবের গড়ে ওঠার পেছনে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। শুধু বাংলা নয়, সারা দেশের অপেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জড়ো করার কাজেও তিনি ছিলেন নিরলস।
এই সর্বভারতীয় সংগঠন গড়ে তোলা, কলকাতায় তার সম্মেলন আয়োজন করা সবেতেই তিনি ছিলেন পুরোভাগে।
যাঁকে নিয়ে স্বপ্নময় চক্রবর্তী উপন্যাস লিখেছিলেন “পাউডার কৌটোর টেলিস্কোপ” সেই মণীন্দ্র নারায়ণ লাহিড়ীর বাড়ি যাওয়া, তাঁর সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠার গল্প শুনেছি আশিসদার কাছ থেকে। মণীন্দ্রনারায়ণ তৈরি করেছিলেন তাঁর ছাত্র নারায়ণ চন্দ্র রানাকে। নারায়ণচন্দ্র আর আশিসদা মিলে শিক্ষক মণীন্দ্রনারায়ণের নামে ট্রাস্ট গড়ে তুলেছিলেন আকাশ দেখার স্বার্থে। নারায়ণ চন্দ্র কম বয়সে মারা যান। আশিসদাও চলে গেলেন।
আশিসদা উত্তর চব্বিশ পরগনার এক জায়গায় বাড়ি করেছিলেন আকাশ দেখার স্বার্থে। এমন জায়গা চাই যেখানে আলো থাকবে না, রাতের আকাশ দেখা যাবে; কালো আকাশের গায়ে সারা রাত ধরে নক্ষত্র দেখা যাবে। কতবার যেতে বলেছেন সেখানে। বলেছেন, “বিকালে চলে এসো। রাতের খাওয়াদাওয়ার পরে রাত জাগতে হবে আকাশ দেখার জন্য”। জীবনের অনেক ব্যর্থতার মতো সেই রাতও জীবনে আনতে পারিনি। আশিসদার সেই বাড়িতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
তবে একটু কাজ করতে পেরেছিও। স্বাধীন ভারতে অপেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস নিয়ে সাম্প্রতিককালে একটু পড়াশোনার চেষ্টা করেছি। সেই কাজ আশিসদাকে ছাড়া হয় নাকি? বন্ধু কৌস্তুভের সাহায্যে আমি আর আমার গবেষকছাত্র সুরাজ এক বিকেলে হাজির হলাম আশিসদার কলকাতার বাড়িতে। আশিসদা চিনতে পারলেন। তবে বললেন, ওঁর স্মৃতি একেবারেই কমে গেছে। পুরনো কথা মনে করতে পারেন না। পড়াশোনা করে গিয়েছিলাম। একেকটা ঘটনার কথা ব’লে বা ওঁর পুরনো লেখা দেখিয়ে স্মৃতি জাগানোর চেষ্টা করলাম। কৌস্তুভ এবং জয়াদিও পুরনো কথা বলতে লাগলেন। মাঝেমধ্যে চোখে আলো জ্বলে উঠছিল ঠিকই তবে সে আলো ক্ষণিকের।
মনে হয়েছিল, গবেষণার কাজটা কেন আর একটু আগে করলাম না!
আশিসদা কত মানুষকে যে আকাশ দেখায় অনুপ্রাণিত করেছিলেন তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু আমাদের সব চর্চার ব্যর্থতার মতো তাতেও তো ফাঁক আর ফাঁকি ছিল। তা না হলে আকাশ দেখার এতো প্রসার, গ্রহ নক্ষত্র চেনার এতো আয়োজনের পরেও আঙুলে আঙুলে এতো ‘গ্রহরত্ন’-এর আংটি ওঠে কিকরে!
আশিসদা আকাশের রূপ দেখে মুগ্ধ হতেন। আর সেই মুগ্ধতাই সঞ্চারিত করতে চাইতেন আমাদের মধ্যে। সে কাজ করার লোক বাড়লেই তাঁর কাজ সার্থক হয়।
তবে আশিসদা জীবন মৃত্যু নিয়ে ভাবিত ছিলেন না। তাঁর মতে আকাশের সৌন্দর্যের কাছে অর্থহীন জীবন ও মৃত্যু…
[পাঠকের প্রতি বিশেষ অনুরোধ লেখাটি পড়ে অবশ্যই মূল্যবান মতামত কমেন্ট বক্সে দেবেন ।]
‐———————————————————
লেখক:
অধ্যাপক সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়,
ইতিহাস বিভাগ , কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়