
ডোবেরেইনারের লাইটার
——————————————
পাথর ঘষে আগুনের স্ফুলিঙ্গ আবিষ্কারের গল্প আমাদের জানা। তারপরও মনে প্রশ্ন উকি দেই এই আগুন জ্বালানোর কৌশল মানুষ নিজের পকেটে পুরল কীভাবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিবর্তনের মধ্যদিয়ে সভ্যতারও বিবর্তন ঘটেছে। আগুন জ্বালানোর ক্ষেত্রে আজ আমরা ব্যবহার করছি দেশলাই কাঠি। কাঠের একটি ছোট টুকরোর মাথায় থাকছে স্ফুলিঙ্গ উৎপাদনের উপযোগী রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রন। আবার দেশলাই বাক্সের বাইরে দুইধারে থাকে রাসায়নিক মিশ্রনের একটি প্রলেপ । কাঠি ও বাক্সের গায়ে লাগানো রাসায়নিকের ঘর্ষণে তড়িৎ স্ফুলিঙ্গ উৎপন্ন হয়। পটাশিয়াম ক্লোরেট ভেঙ্গে গিয়ে অক্সিজেনের যোগান দেয়। লাল ফসফরাস ও অ্যান্টিমনি ট্রাইসালফাইড অক্সিজেনের প্রভাবে জ্বলে উঠে। আদতে অ্যান্টিমনি ট্রাই সালফাইড আগুনকে কিছুটা দীর্ঘস্থায়ী করে । কিন্তু আগুন জ্বালানোর এই সহজ কৌশল সভ্যতার কাছে খুব বেশী প্রবীণ নয় । প্রস্তুরযুগ থেকে যাত্রা করে লৌহযুগ, ব্রোঞ্জের যুগ পেরিয়ে আধুনিক সভ্যতায় পাড়ি দিতে দিতে মানুষ পথে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কৌশল আগুন জ্বালানোর জন্য বেছে নিয়েছে। তবে প্রায় সব জায়গাতেই ঘর্ষণই ছিল মুখ্য কারণ। ঘর্ষণে কখনো ব্যবহৃত হয়েছে পাথর, ধাতব পাত আবার কখনো কাঠের টুকরো। কিন্তু কৌশলটিকে আরও সহজ করার প্রয়োজন ।
কেমন করে যেন এই দায়িত্বটা চলে এল ডোবেরেইনারের কাঁধে । এই জার্মান বিজ্ঞানী জোহান উলফগ্যাং ডোবেরেইনার যিনি ফর্মাল এডুকেশান পাননি এবং আমাদের সঙ্গে উনার প্রথম পরিচয় ত্রয়ী সুত্রের মাধ্যমে। মেরেকেটে ২৫ টি মৌলও তখন আবিষ্কৃত হয়নি । কিন্তু তাদেরকে নিয়ে সুনির্দিষ্ট ভাবে চর্চার প্রয়োজন বোধ করছিলেন বিজ্ঞানী মহল । তিনি খুঁজে বের করলেন একটি সুত্র। বেছে নিলেন লিথিয়াম, সোডিয়াম ও পটাশিয়ামকে। উলম্বভাবে সাজাতে গিয়ে মাঝে রাখলেন সোডিয়ামকে যার পারমানবিক ভার ২৩ যা কিনা বাকী দুজনের ( লিথিয়াম ৭ ও পটাশিয়াম ৩৯) পারমানবিক ভারের গড় । এসব নিয়ে তো ভালোই ছিলেন । আবার এর পাশাপাশি লাইটার বানানোর দায়িত্বটাও উনার কাছেই এলো। সহজ উপায়ে আগুন জ্বালাতে হবে । বানালেন অনেকটা কিপ যন্ত্রের মতন একটি যন্ত্র, যেখানে নিচের অংশে জিঙ্কের সাথে লঘু সালফিউরিক অ্যাসিডের বিক্রিয়ায় হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। প্রয়োজনে নবটি খুলে দিলে গ্যাস চলে আসে উপড়ে। গ্যাসকে পাঠানো হয় প্ল্যাটিনাম স্পঞ্জের মধ্য দিয়ে, এবার স্পার্ক কর আর আগুন জ্বালাও ।
কিন্তু গল্পটা একটু অন্য রকম। ১৮২৩ সালে অ্যামোনিয়াম হেক্সাক্লোরোপ্ল্যাটিনেট কে উত্তপ্ত করে বানিয়েছিলেন প্ল্যাটিনাম স্পঞ্জ। গ্যাসোমিটার থেকে ক্যাপিলারির মাধ্যমে হাইড্রোজেন গ্যাসকে বাতাসের সংস্পর্শে আনলে লোহিত তপ্ত অথবা স্বেততপ্ত রূপ ধারন করে এবং তৎক্ষণাৎ আগুন জ্বলে উঠে । হাইড্রোজেন ও বাতাসের অক্সিজেনের সংযোগে উৎপন্ন হয় জল অথচ প্ল্যাটিনাম স্পঞ্জের তো কোন পরিবর্তন হয়নি। রাসায়নিক ক্রিয়া শেষে নিজেকে অপরিবর্তিত রেখেছে। অর্থাৎ এখানে বিক্রিয়ার সহায়ক হিসেবে অনুঘটকের ভূমিকা নিয়েছে । এখানে প্ল্যাটিনাম স্পঞ্জ অসমসত্ব অনুঘটকের ভূমিকা নিয়েছে । এখানে এটাকে বলা চলে একটি ভিন্নধর্মী অনুঘটক । এমন একটা সময় তখন পর্যন্ত অতি সাধারণ উপায়ে আগুন জ্বালানোর কৌশল মানুষের জানা ছিল না । সেখানে ডোবেরেইনারের এই ধারনা এক অন্য মাত্রা নিয়েছে। তিনি হাইড্রোজেন লাইটার সফলভাবে বানাতে সক্ষম হলেন যা ডোবিনারের ল্যাম্প নামে পরিচিত। ল্যাম্প আবিষ্কারের পাশাপাশি ডোবেরেইনার সহ পরবর্তী বিজ্ঞানী মহল পেল রাসায়নিক বিক্রিয়ার নতুন দিশা। ডোবেরেইনার নিজেও পরবর্তীতে সালফার ডাই অক্সাইডকে ট্রাই অক্সাইডে রূপান্তর ঘটাতে প্ল্যাটিনামকে অনুঘটক হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন যা সালফিউরিক অ্যাসিডের উৎপাদনে প্রয়োগ করা হয় । রিলে দৌড় প্রতিযোগিতায় একজন যেমন আরেকজনের হাতে ব্যাটন তুলে দেয় সেরকমই ডোবেরেইনার অনুঘটক তৈরির পথকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে তুলে দিয়েছেন পরবর্তী বিজ্ঞানীদের হাতে ।
(ছবি সৌজন্য: গুগল)
——–‐——————————————————-
[পাঠকের প্রতি বিশেষ অনুরোধ লেখাটি পড়ে অবশ্যই মূল্যবান মতামত কমেন্ট বক্সে দেবেন ।]
লেখক ড.তপন দাস , প্রধান শিক্ষক ও বিজ্ঞান লেখক ।