Posted on: July 8, 2024 Posted by: Editor Desk Comments: 0
Spread the love

মেঘের  আড়ালে থাকা এক ছাত্র  :

সে আমার এম এ-এর ছাত্র। তবে ছাত্রাবস্থায় সে যে খুব নজর কেড়েছিল তা নয়। কথাই বলত না! এম ফিল-এ আবেদন করল। আবেদন করার আগে প্রস্তাবিত গবেষণার সংক্ষিপ্তসার দেখাতে এলো। দেখাতে এলো বললে ভুল বলা হবে। মেল করলো। আমিই এসে দেখা করতে বললাম। আসলে সেই সংক্ষিপ্তসারে অসম্ভব অধ্যাবসায় আর পরিশ্রমের ছাপ ছিল।

আমার বিষয় দেখে একটু অনুরাগই জন্মাল। আড়াই দশক আগে যখন বিজ্ঞান আন্দোলনের ইতিহাস অনুসন্ধানের জন্য পি এইচ ডি গবেষণা শুরু করেছিলাম তখন আমাকে এই বিষয়টা যে ইতিহাসের বিষয় হতে পারে সেটা সকলকে বোঝাতে হতো। সেই সময়ে আমার ওপর ভরসা রেখেছিলেন আমার সুপারভাইজার অধ্যাপিকা মহুয়া সরকার। নতুন বিষয়কে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গকেন্দ্রিক সেই ইতিহাস ২০০৫এ পি এইচ ডি পেয়েছিল। তখন থেকেই মনে হচ্ছিল জেলাভিত্তিক বিজ্ঞান আন্দোলনের ইতিহাস অনুসন্ধান করলে কেমন হয়! সেই ভাবনা কাজে রূপ পেল কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পরে। প্রথমে সুকল্যাণ উত্তর ২৪ পরগনা নিয়ে কাজ করল, তারপর মনামী হাওড়া আর হুগলি নিয়ে আর শুভেন্দু মুর্শিদাবাদ নিয়ে। নদীয়া মুর্শিদাবাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নদীয়া নিয়ে কাজ হবে না? 

এই প্রশ্নের জবাব ছিল তার সংক্ষিপ্তসারে। এম ফিলের ইন্টারভিউ ভালই দিল মুখচোরা সেই ছেলে। তার ইউ জি সি র জে আর এফ-ও ছিল। এম ফিল ছাত্রের তালিকায় তার নাম উঠল।

কাজ করার সময়ও কথা বলত খুব কম, শুনত বেশি। শুধু হুঁ-হাঁ করত। 

যা হয়, চাকরি তো দরকার। এম ফিল শেষ হলে ফেলোশিপ বন্ধ হয়ে যাবে। পি এইচ ডি তে সুযোগ পাওয়া কঠিন। আর ছাত্রদের মধ্যে তখন দীর্ঘ দিন ধরে স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা না হওয়া নিয়ে হাহুতাশ। তাকে কখনও হাহুতাশ করতে দেখিনি। সে মাঝে মাঝে হোয়াটসঅ্যাপে এক একটা তালিকা পাঠাতে শুরু করল। তালিকাগুলো এরাজ্যেরই বিভিন্ন মিশন স্কুলের চাকরির বিভিন্ন পর্বের তালিকা। কারা কারা লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হল, কারা ইন্টারভিউয়ে ডাক পেল, প্যানেলে কাদের নাম উঠল এরকম তালিকা। কোনোটা রামকৃষ্ণ মিশনের, কোনোটা ভারত সেবাশ্রম সংঘের। সব তালিকাতেই তার নাম থাকত। ইন্টারভিউয়ে ডাক পেত সে-ছেলে। তিনজনের প্যানেলেও নাম থাকত। তিনে... দুইয়ে...। শেষ অবধি এক-এ। সে, স্কুলে চাকরি পাওয়া যাচ্ছে না, এমন অবস্থায় এক মিশন স্কুলে চাকরি পেল। এমন এক স্কুল, যেখান থেকে কয়েক বছরের মধ্যেই রাজ্যে মাধ্যমিকে প্রথম হয়েছে এক ছাত্র।

এ তো গেল তার পড়ানোর গল্প। প্রতিকূলতার মধ্যেও সে এম ফিল গবেষণা শেষ করল। আমার ভূমিকা ছিল এটা বলা যে "তুমি পারবে"। সেই সময় আমার দুজন ছাত্র সুজিত আর সুরাজ নানাভাবে ওর পাশে রইলো। 

এম ফিল ডিগ্রি পেল সে। পরীক্ষক তার কাজের নিষ্ঠার প্রশংসা করলেন ভাইভা নিতে এসে।

ইতিমধ্যে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ইতিহাসের সহকারী অধ্যাপক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে সে। আমি জানতাম তথ্যে সে আটকাবে না। এতো ভাইভা দিচ্ছে, প্যানেলে থাকছে... সরকারি কলেজে কি পাবে না চাকরি?

আজ সেই প্যানেলে ঠাঁই করে নিয়েছে সে। কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজে পড়া সেই ছেলে এবার নিজেই গভর্নমেন্ট কলেজে পড়াবে। 

নিজেকে বরাবরই লুকিয়ে রাখা সে ছেলে সার্থকনামা। মেঘের আড়ালে লুকিয়ে যুদ্ধ করার কথা আমরা মহাকাব্যে পড়েছি। সেও যুদ্ধ করছিল। তার অস্ত্রগুলোর নাম নিষ্ঠা, অধ্যাবসায়, পরিশ্রম, হার না মানা মনোভাব আর চোখ কান খোলা রাখা। 

সে মেঘনাদ। তার নাম ইন্দ্রজিৎ। ওর সাফল্যের গল্পটা যদি আমার অন্য ছাত্রদের ভালো লাগে তবে তাদের বলব ওর অস্ত্রগুলো হাতে তুলে নাও। আর একটু আড়ালে থেকেই নিজেদের লড়াইটা লড়তে থাকো...

 

[পাঠকের প্রতি বিশেষ অনুরোধ লেখাটি পড়ে অবশ্যই মূল্যবান মতামত কমেন্ট বক্সে দেবেন ।]

 

‐———————————————————

লেখক:

অধ্যাপক সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়,

 ইতিহাস বিভাগ , কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়


Spread the love

Leave a Comment