
আবারও বেআইনি বাজি কারখানার বিস্ফোরণে পূর্ব মেদিনীপুর-এ কোলাঘাট-এর নিকটবর্তী কিছু গ্রাম কেঁপে উঠল। বিভিন্ন সামাজিক ও গণমাধ্যমের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, কয়েকটি বাড়ি ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। ইজরায়েল-প্যালেস্টাইনের যুদ্ধ নিয়ে আমরা বড়ই চিন্তিত, তারই যেন এক খণ্ডচিত্র কোলাঘাটের গ্রামজুড়ে; আর তার সঙ্গে প্রান্তিক মানুষের বিলাপ-ধ্বনি। সরকার নির্বিকার।
বিগত বছরে ২০২৩ সালেই দত্তপুকুর অঞ্চলে মোট পাঁচটি বেআইনি বাজি কারখানায় এমন ধরনের বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল। এর কিছুদিন আগে এগরা-র বিস্ফোরণে এগারোটি তরতাজা প্রাণ চলে যাওয়ার পর সংবাদ মাধ্যমে এই নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে হইচই চলে। বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনের লাগামহীন সন্ত্রাস নিয়ে আলোচনার সময়েও উঠে আসে এই বেআইনি বাজি কারখানাগুলির প্রসঙ্গ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ২০০৯ সাল থেকে ক্রমাগত পশ্চিমবঙ্গের বুকে মাটি কেঁপে উঠেছে বেআইনি বাজি তৈরির বিস্ফোরণ। মৃত্যু মিছিল অব্যাহত। শিশুও ছাড় পায়নি এই মৃত্যুর হাত থেকে। আমরা ‘পরিবেশ আকাদেমি’র পক্ষ থেকেও প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে এই বিষয়টি নিয়ে আবেদন-নিবেদন করেছিলাম। দেশে এই বিষয়ে একাধিক আইন রয়েছে। বিষয়টা নিয়ে মহামান্য আদালতও বিভিন্ন সময়ে রায় জারি করেছেন। রয়েছে গ্রিন ট্রাইব্যুনাল-এর সুনির্দিষ্ট নির্দেশাবলি। রাজ্য সরকার এই সকল রায় এবং নির্দেশ কার্যকরী করতে দায়বদ্ধ।
এই বিষয় নিয়ে গ্রিন ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়েছে। মামলা চলছে, কিন্তু তার নিষ্পত্তি কবে কীভাবে হবে, তা কারোরই জানা নেই। দুর্ভাগ্যবশত আজকের ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে এই সত্য উদ্ঘাটন করে দিল যে, সবই কথার কথা। রাজ্য সরকার কিংবা প্রশাসনের কোনও দপ্তরেরই বিষয়টা নিয়ে আদৌ কোনরকম ভাবনা-চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। বেআইনি বাজি কারখানাগুলি বহাল তবিয়তে চলছে । একের পর এক বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রাণ চলে যাচ্ছে অসহায় মানুষের। প্রশাসন ঘুমের দেশে। তার এই নির্লিপ্ততা যেন সমাদরে অসহায় গরিব মানুষের মৃত্যুকে ডেকে আনছে।
সামগ্রিক পরিস্থিতি কিন্তু ভয়াবহ। বেআইনি বাজি কারখানা বা শব্দবাজির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বহু মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। তাঁদের ক্ষতিপূরণের দাবিতে উচ্চ আদালতে মামলা রুজু হয়েছে ২০১৩ সালে। সে মামলা আজও বিচারের বাণীর প্রতীক্ষারত।
আমাদের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই রাজ্যে লাইসেন্স বিহীন আতশবাজি ও শব্দবাজি উৎপাদন কেন্দ্রগুলিতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ২৫টি। এখানে অবশ্যই উল্লেখের যে, এইসব ঘটনায় যাঁরা মারা গিয়েছেন বা আহত হয়েছেন, তারা সবাই গরিব প্রান্তিক ঘরের মানুষ। যেহেতু এই বাজি কারখানাগুলো পুরোপুরি বেআইনি, সরকারের খাতায় এদের কোন নামই নেই, তাই এই মানুষরা আহত হলে, এমনকী বিস্ফোরণে মৃত্যু হলেও বেআইনি বাজি কারখানার মালিকের থেকে বা সরকারের থেকে কোনরকম ক্ষতিপূরণ এঁরা বা এঁদের পরিবার পান না। এঁদের কোনরকম সরকারি সামাজিক সুরক্ষা মেলে না। এঁদের মৃত্যু সরকারকে অণুমাত্র ভাবায় না।
এমন একটা অবস্থায় আমরা কিন্তু চুপ করে বসে থাকতে পারি না। ‘পরিবেশ আকাদেমি’র পক্ষ থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আগামী সপ্তাহের মধ্যেই বিষয়টি গ্রিন ট্রাইব্যুনালে তোলা হবে। সহমর্মী প্রতিটি সংগঠন এবং সমমনোভাবাপন্ন মানুষের কাছে আমাদের আহ্বান, আসুন, আমরা সকলে মিলে এই ভয়ংকর অবস্থা এবং প্রশাসনিক ঔদাসীন্যের বিরুদ্ধে সংগঠিত হই। প্রত্যেকে যে যেমন ভাবে পারেন, প্রতিবাদ জানান, প্রতিরোধ গড়ে তুলুন ।
আপনাদের সকলের কাছে আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ, আপনাদের কারোর কাছে যদি এমন কোন বেআইনি বাজি কারখানার অবস্থিতি সম্পর্কে কোনরকম সংবাদ থাকে, সেই তথ্য বিশদে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিন । যিনি এমন সংবাদ দেবেন, তাঁর বা তাঁদের নাম প্রকাশ না করার বিষয়ে আমরা অতীতেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম, আছি এবং থাকব। প্রয়োজনে নিচের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর দুটির যে কোন একটিতেও আপনারা এই সংবাদ পাঠাতে পারেন ।
আমাদের সংগৃহীত ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই রাজ্যে বেআইনি বাজি উৎপাদন কেন্দ্রগুলিতে বিস্ফোরণের ঘটনায় হতাহতের তালিকাটি নিচে দেওয়া হল।
১। জুন, ২০০৯ কালনা, জেলা- পূর্ব বর্ধমান, দুর্ঘটনার কবলে ৮ জন।
২। সেপ্টেম্বর, ২০১০, ধনেখালি, জেলা- হুগলি, হতাহত- ৬ জন।
৩। অক্টোবর, ২০১১, কোলাঘাট, পূর্ব মেদিনীপুর, হতাহতের সংখ্যা ৩ জন।
৪। সেপ্টেম্বর, ২০১৩, কালনা, জেলা- পূর্ব বর্ধমান, হতাহতের সংখ্যা ২ জন।
৫। সেপ্টেম্বর, ২০১৩, পাঁশকুড়া, জেলা- পূর্ব মেদিনীপুর, হতাহতের সংখ্যা ৩ জন।
৬। অক্টোবর, ২০১৩, বেগমপুর, জেলা- হুগলি, হতাহতের সংখ্যা ৪ জন।
৭। সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ময়না, জেলা- বর্ধমান, হতাহত ৩ জন।
৮। মে, ২০১৫, পিংলা, জেলা- মেদিনীপুর পশ্চিম, দুর্ঘটনাগ্রস্ত ১২ জন।
৯। ২০১৬, তপসিয়া, কলকাতা, আহত ৬ জন।
১০। ২০১৬, বজবজ, হতাহতের সংখ্যা দুইজন।
১১। ২০১৬, নীলগঞ্জ, হতাহতের সংখ্যা একজন।
১২। ২০১৭, তেলিনিপাড়া- হুগলি জেলা, আহত ২ জন।
১৩। ২০১৭, চম্পাহাটি, হত- ১, আহত- ৩ জন।
১৪। ২০১৭, আমডাঙ্গা, উত্তর ২ পরগনা, হত- ৫, আহত- ১৫ জন।
১৫। ২০১৮, হালিশহর, উত্তর ২৪ পরগনা, হত- ৩, আহত- ৩ জন।
১৬। ২০১৮, মগরাহাট, হুগলি, হত- ৩, আহত- ৩ জন।
১৭। ২০১৯, কাঁথি, মেদিনীপুর পূর্ব, হত- ২, আহত- ৪ জন।
১৮। ২০১৯, মহেশতলা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হতাহতের সংখ্যা দুই জন।
১৯। ২০১৯, কেশপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, হতাহতের সংখ্যা- ১ জন।
২০। ২০২০, নৈহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা, হতাহত- ৫ জন।
২১। ২০২১, নোদাখালি, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হতাহতের সংখ্যা- ৩ জন।
২২। ২০২৩, মহেশতলা, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, হতাহতের সংখ্যা- ৩ জন।
২৩। ২০২৩, এগরা, পূর্ব মেদিনীপুর, হতাহতের সংখ্যা- ১১ জন।
২৪। ২০২৩, বজবজ, উত্তর ২৪ পরগনা, হতাহতের সংখ্যা- ৩ জন।
২৫। ২০২৩, দুবরাজপুর, বীরভূম, হতাহতের সংখ্যা- এখনও শনাক্ত করা যায়নি।
২৬। ২০২৩, দত্তপুকুর, কলকাতা, হতাহতের সংখ্যা- এখনও শনাক্ত করা যায়নি।
২৭। ২০২৪, পয়াগগ্রাম, কোলাঘাট, পূর্ব মেদিনীপুর, হতাহতের সংখ্যা- এখনও শনাক্ত করা যায়নি।
[পাঠকের প্রতি বিশেষ অনুরোধ লেখাটি পড়ে আপনার মূল্যবান মতামত অবশ্যই কমেন্ট বক্সে দেবেন ।]
লেখক :
বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়, সমাজ ও পরিবেশকর্মী,
চলভাষ- ৮৪২০৫২৯৯৬৬
এবং
রাহুল রায়, পরিবেশকর্মী,
চলভাষ- ৯৪৩৩৫৭৫৩৬৪