Posted on: June 9, 2024 Posted by: Editor Desk Comments: 0
Spread the love

নোয়াই খাল, নাকি নোয়াই নদী, নাকি কোনা এক সময়ের লাবন্যবতী? সেই খোঁজ জারি আছে বিগত কয়েক বছর ধরেই। জারি আছে মৃতপ্রায় ও দূষণ জর্জরিত সোনাই, নোয়াই নদী ও তাদের উৎস বর্তি বিলের যথাযোগ্য সংস্কারসাধন করে জলাশয়গুলোর স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার ও সংলগ্ন মানুষের যাপন সুনিশ্চিত করার দাবি। সেই খোঁজের শরিক হতে আমরা জনা পনেরো মিলে বেরিয়ে পড়ি সাহাপুর তেঁতুলতলা থেকে নোয়াই এর উৎস মুখের দিকে। বিশ্ব পরিবেশ দিবসকে সামনে রেখে ৮ জুন এই নদী যাত্রায় সামিল হয়েছিলেন রানাঘাট-কল্যাণী- কাঁচরাপাড়া-নৈহাটি-ব্যারাকপুর-খড়দা-দমদম-তেঘরিয়া এবং কলকাতা থেকে আসা প্রকৃতি প্রেমিক মানুষজন।

দেখে নেওয়া যাক বর্তি বিল ও তার সন্ততি সোনাই, নোয়াই নদীর ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থান। মূলত: উত্তরে বারাকপুর– কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের পূর্ব দিকে গুড়দহ এলাকা থেকে দক্ষিনে নীলগঞ্জ বাস স্টপেজের অল্প উত্তর পর্যন্ত এবং পূর্বে বড়গাছিয়া–তপনপুরের মাঝামাঝি থেকে পশ্চিমে বারাকপুর–কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের ১ কিলোমিটার আগে পর্যন্ত প্রায় ৬ কিলোমিটার x ৬ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে বর্তির বিল। ছোট-বড় অনেকগুলি বিল, জলাভূমি, স্থানীয় গ্রাম, চাষের জমি নিয়ে এই এলাকা। গঙ্গা থেকে ইছাপুর খালের মধ্যে দিয়ে সরাসরি গঙ্গার জল ঢোকে এখানে। তেলিনীপাড়ার অল্প উত্তর থেকে উৎপত্তি সোনাই নদীর, যার বর্তমান পরিভাষা খাল এবং যা প্রায় মৃত। অন্যদিকে সাহাপুর গ্রামের উত্তরে কমবেশী ২ কিলোমিটার আগে বর্তির বিল থেকে জন্ম নিয়েছে আর এক কন্যা নোয়াই, যা দক্ষিনে কালিন্দী নদীতে গিয়ে পড়েছে। এই নোয়াই একসময় লাবণ্যবতী নদী হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিল স্থানীয় মানুষজনের কাছে। যার বুকের ওপর দিয়ে বয়ে যেত বাণিজ্য তরণী আর মাছ ধরার নৌকো। হায়রে পোড়া কপাল! আজ তোরে চেনে লোকে খাল বলে।

নদীর পাড় বরাবর ঘণ্টা দুয়েক ধরে চলা যাত্রার উদ্দ্যেশ্য: নোয়াই নদী দেখা এবং সংলগ্ন অঞ্চলের ভূমিরূপ, জীববৈচিত্র্য পর্যবেক্ষন করার চেষ্টা। সংলগ্ন এলাকার মানুষের যাপন অনুধাবন করার প্রচেষ্টা।

কী দেখলাম, বুঝলাম, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলাম তার একটি ছোট প্রতিবেদন রইল বন্ধুদের জন্য। প্রথমেই বলে রাখি, সাহাপুরে নদী পারাপারের কাঠের ব্রিজ ছাড়ালেই একটি সরকারি সাইনবোর্ড: নদীর তীরবর্তী এলাকায় যেসব বিষধর ও বিষহীন সাপ পাওয়া যায় তার উল্লেখ সহ। যাত্রাপথের শেষের দিকে আরেকটি সাইনবোর্ড: এলাকায় বসবাসকারী পাখ পাখালির ঠিক ঠিকানা। এই সাইন বোর্ড দুটি নোয়াই নদীর তীরে জীব বৈচিত্র্যের স্বাক্ষ্য বহন করে। মাছ ধরার একটি বড় বাঁধাল চোখে পড়ল, যা নদীকে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট। দেখলাম নদীর পাড় ও তীরবর্তী উর্বর জমিতে বিনা সারে প্রচুর সবজি চাষ, কলা ও আমের বাগান। চোখে পড়ল লেজ ঝোলা ফিঙে পাখি সহ তাদের বাসা। যাতায়াতের পথে অন্যান্য আরো অনেক পাখির দেখা পাওয়া গেল, শোনা গেল তাদের কুহুতান। স্থানীয় মানুষরা জানাচ্ছেন: শীতকালে পরিযায়ী পাখির মেলা বসে এখানে। যদিও মাঝে শহুরে পাখি শিকারির উপদ্রব বেড়ে গেলে বনদপ্তরের সাহায্যে গ্রামের মানুষ চোরা শিকার বন্ধ করতে সক্ষম হন। তাঁরা বলছেন পাখি, প্রকৃতির বন্ধু। পাখিকে মারা চলবে না। বর্ষায় ছোট নৌকো করে চ্যাং ল্যাঠা টেংরা মাগুর ধরা চলে সোৎসাহে।

এতো বৈচিত্র্যময় একটি জীবন্ত প্রাকৃতিক সত্তা দেখেও মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।
সংস্কারের অভাবে কচুরিপানা, টোকাপানায় ঢেকে গেছে জলস্তর। তবুও প্রভাতে রবির কিরণ প্রতিবিম্ব ফেলে ঝিলিক মারা জলের বুকে। অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানিয়ে রাখি, শ্যামনগরের এক্সাইড ব্যাটারি কারখানা ও সাহাপুরের একাধিক আইনি বেআইনি গেঞ্জি কারখানার বিষাক্ত ও দূষিত কালো জলে নোয়াই আজ কৃষ্ণকলি। কালো জল ও মাটি সংগ্রহ করে আনা হয়েছে পরীক্ষার জন্য। কয়েক হাজার গ্রামবাসীর সইসাবুদ সহ প্রতিবাদ পত্র তিন তিনবার জমা দেওয়া হয়েছে সেচ দপ্তরে নদীর দূষণ প্রতিরোধে ও সংস্কারের দাবিতে।
সেচ দপ্তর উবাচ – নোয়াই কোন সেচ খাল নয়, এটি নাকি নিকাশি খাল। তাই তাঁরা কিছু করতে পারবেন না। করবেন কোন্ দপ্তর? তার উত্তর অধরা।

অর্থাৎ একটি জীবন্ত নদীকে নানান উপায়ে মেরে ফেলে তাকে সরকারি দপ্তর বানিয়ে দিল খাল। সাথে এও স্বীকার করে নিল: শহরের সমস্ত দূষিত নিকাশি জল বয়ে যাবে নোয়াই নদীর বুক চিরে। এটাই নাকি উন্নতি, এটাই সভ্যতা! বর্তির অন্য অংশে ইকো ট্যুরিজম গড়ে ওঠার কথা শুনলাম। এই ট্যুরিজম স্থানীয় ইকোলজিকে কতটা বিপদগ্রস্ত করেছে, তা দেখে শুনে বুঝে আসতে চাই সকলে মিলে। আমরা সোচ্চারে বলতে চাই –সোনাই, নোয়াই নদী ও তাদের উৎস বর্তি বিলকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে অবিলম্বে যথাযথ সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হোক। অবিরল নির্মল নদী ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হোক। বাঁচুক নদী, জীবন্ত থাকুক প্রাণ প্রকৃতি। নদী সংলগ্ন মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপন সচল থাকুক।
প্রতিবেদনে: সন্তোষ সেন: ৯/৬/২০২৪


Spread the love

Leave a Comment