
আজ ৫ই জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবস। আমরা আমাদের পরিবেশ নষ্ট করেছি এবং প্রতি নিয়ত ধ্বংস করে চলেছি । একথা আমরা সবাই জানি এবং মেনে নিয়েছি কিন্তু মনে নিয়েছি কি ? এই ভাবনা আজকের নয় প্রায় ৫৬ বছর আগে ১৯৬৮ সালে পরিবেশ নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা ভাবনা শুরু হয় । শুরু হয় পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন । চারবছর পর ১৯৭২ সালে জাতিসঙ্ঘের পরিবেশ বিষয়ক স্টকহোম সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৭৩সাল থেকে প্রতিবছর ৫ই জুন সংযুক্ত জাতিসংঘের পরিবেশ প্রকল্প বা ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (UNEP) এর নেতৃত্বে বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়। জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি, ব্যবসায়ীক সংগঠন যারা পরিবেশ নিয়ে চিন্তাভাবনা বা কাজ করে, তারা এইদিন জনসাধারণ এর মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। মানুষের সাথে পরিবেশের সম্পর্ক বা নির্ভরতার চিন্তা থেকেই পরিবেশ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত।
এই পৃথিবী শুধু মানুষের জন্য নয়। পশু, পাখি, গাছ, মাছ, মানুষ – আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের ওপর নির্ভরশীল। গাছের দ্বারা উৎপন্ন অক্সিজেন যেমন প্রাণীর প্রয়োজন, তেমন গাছের বীজকে দূরে দূরান্তে ছড়িয়ে নতুন চারাগাছ তৈরিতে প্রাণী সহায়তা করে। উদ্ভিদ থেকে প্রাথমিক ভাবে প্রাণীরা খাদ্য সংগ্রহ করে। আবার প্রাণীর বর্জ্য মাটিতে মিশলে তা থেকে গাছ খাদ্যপ্রাণ সংগ্রহ করে। এই চক্রই বলে দেয়, একজন না থাকলে অন্য জনের অস্তিত্ব বিপন্ন।
সমুদ্র দূষণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বিশ্ব উষ্ণায়ন, বন্যপ্রাণ হত্যা, অরণ্য ধ্বংস জাতীয় পরিবেশগত সমস্যা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য পরিবেশবান্ধব সংগঠনগুলির সৃষ্টি। প্রত্যেক বছর একএকটি বিষয় বেছে নিয়ে তার ওপর আলোচনা, প্রচার ও সচেতনতা তৈরি করা হয়। বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২৪ এর মূল আলোচ্য বিষয় “আমাদের ভূমি” শিরোনামে প্রাকৃতিক ভূমি পুনরুদ্ধার, মরুপ্রসারণ রোধ এবং খরাক্লিষ্ট জমিকে পুনরায় চাষযোগ্য করে তোলা।
উপরিউক্ত তিনটি সমস্যারই মূলে আছে জলের অপ্রতুলতা। আবার মাটি ও জলের সুষম চরিত্রের সাথে সম্পর্কিত উদ্ভিদ জীবন। গাছ যেমন মাটিকে ও তার অন্তর্গত জলকে ধরে রাখে, তেমন সেই জলও গাছকে খাদ্যপ্রাণ দিয়ে সতেজ রাখে। মরু বা খরাপ্রবণ অঞ্চলে যেমন গাছপালা জন্মায় না, তেমনই বেহিসাবি বৃক্ষছেদন এর ফলে সৃষ্টি হতে পারে মরুভূমি বা খরা প্রবণ অর্থাৎ বৃষ্টিচ্ছায়া অঞ্চল। উদ্ভিদ মাটি ও জলকে ধরে রেখে মাটির চরিত্র বজায় রাখে। তাই বলা যায় কৃত্রিম বনসৃজনই তিনটি সমস্যার অন্যতম সমাধান। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ পুরুলিয়া জেলার মানবাজার -১ ব্লকের ঝাড়বাগদা গ্রামের অধিবাসীদের দ্বারা সৃষ্ট ২৭৫একরের কৃত্রিম বনসৃজন যা আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্ত্তৃক স্বীকৃত। ২০২৪এর পরিবেশ দিবস পালনের উদ্যোক্তা দেশ হলো সৌদি আরব ।
‘ভূমি পুনরুদ্ধার’ হল পরোক্ষে সারা বিশ্বে জীব বৈচিত্রের সুরক্ষা এবং পুনরুজ্জীবন যা দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সময়কে ফিরিয়ে আনতে পারি না, তবে বনাঞ্চল বাড়াতে পারি, জলের উৎস পুনরুদ্ধার করতে পারি এবং মাটির মূল প্রাকৃতিক চরিত্র ফিরিয়ে আনতে পারি। জমির ব্যবহার নিয়ে সুস্থ চিন্তা করতে পারি। আগামী দিনে মানব সভ্যতার দুই তৃতীয়াংশ মানুষ চাহিদামত জল পাবেন না। তাই গত ১লা মার্চ, ২০২৪, কেনিয়ার নাইরোবিতে জাতিসংঘের পরিবেশ পরিষদের ষষ্ঠ সম্মেলনে (UNEA) ১৫ টি সংকল্প গ্রহণ করা হয়। এগুলি জলবায়ু পরিবর্তন, জীব বৈচিত্রের ক্ষতি ও দূষণ এর ওপর দৃষ্টি রেখেই তৈরি করা হয়েছে ।
দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার দেশগুলি সঙ্কটজনক অবস্থার কাছাকাছি আছে। আমাদের দেশের বহু অঞ্চলে জল সঙ্কট ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছে । ভূগর্ভস্থ জলের সঞ্চয় দ্রুত কমে আসছে । নেমে যাচ্ছে বিপদজনক স্তরে । গত মার্চমাসে ব্যাঙ্গালুরুর মত হাই টেক শহরের জল সঙ্কট প্রায় বিপর্যয়ের আকার নিয়েছিল ।
জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি, অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন ও নগর উন্নয়ন, অপরিমিত বৃক্ষছেদন বা বনভূমি ধ্বংস, দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দূষণ ও ভূমি উন্নয়নের জন্য এই সংকট। জলের ঘাটতি যেমন খাদ্য নিরাপত্তা কে বিঘ্নিত করছে, তেমন জীব বৈচিত্র্যকেও প্রভাবিত করছে যা আগামীদিনে আরও প্রকট হবে। তাই সমস্যা সমাধানের জন্য সামাজিক বন সৃজনের দিকেও নজর দিতে হবে।
মিষ্টি জলের বেশির ভাগটাই আসে মাটির নিচে থেকে। কিন্তু অত্যধিক ব্যবহার ও পূরণ না করার কারণে সেই জল বিপজ্জনক ভাবে কমে গেছে। উষ্ণায়নের জন্য সমুদ্রের জলের উষ্ণতা ও জলতলের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য সমুদ্রের নিকটবর্তী জনপদ বা কিছু ছোট ছোট দ্বীপের জনবসতি বিপদের সম্মুখীন । সেই সব অঞ্চলের মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিনত হচ্ছেন । জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্ব উষ্ণায়নের জন দায়ী বিভিন্ন কারণের মধ্যে ভূমিক্ষয় এবং মরুভূমির সম্প্রসারণ অন্যতম ।
বিগত পাঁচ দশক ধরে পরিবেশ পালনের মাধ্যমে জন চেতনা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে । জলের অপচয় রোধের চেতনা বৃদ্ধি হলে জলের সঞ্চয় বাডবে । ২০২৪ সালের এপ্রিল এবং মে মাসে পূর্ব ও পশ্চিম ভারতে দিন ও রাতের তাপমাত্রা বেড়েছে । পূর্ব ভারতে তাপমাত্রা ৪৮ ডিগ্রি ও উত্তর,উত্তরপশ্চিম, পশ্চিম এবং মধ্য ভারতে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রির কাছাকাছি রেকর্ড হয়েছে । যেভাবে দীর্ঘদিন ধরে তাপপ্রবাহ এবং উষ্ণ রাত মানুষকে সহ্য করতে হয়েছে তা অভূতপূর্ব । ফলে মানুষের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা ধীরে ধীরে বাড়ছে । হুগলী জেলার ভদ্রেশ্বরের সাংস্কৃতিক সংগঠন রবিচক্র এবং ভ্রমণ আড্ডা যৌথভাবে পরিবেশ দিবস পালন করবে গঙ্গার ঘাটের কাছে । পরিবেশ সম্পর্কে বলার জন্য ও জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিশিষ্ট জন উপস্থিত থাকবেন । তাছাড়া বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রকল্প ও আইনি সহায়তায় সামাজিক বনসৃজনের মাধ্যমে কৃত্রিম বনাঞ্চলের সৃষ্টি করে মাটি বা ভুপ্রকৃতিকেকে রক্ষা করা সম্ভব । অরণ্য, জল ও জীব বৈচিত্র্য রক্ষাতেই হলো পরিবেশ দিবস পালনের সার্থকতা। তবে শুধু পাঁচই জুন নয় বছরের বাকি ৩৬৪ দিনও আমাদের কাছে পরিবেশ দিবস হয়ে না উঠলে এবং সাধারণ মানুষের সহযোগিতা না থাকলে দিনটি আনুষ্ঠানিক হয়েই থেকে যাবে । কাজের কাজ কিছুই হবেনা ।
অজয় নাথ , লেখক -গবেষক ও বিজ্ঞান প্রাবন্ধিক ,
e.mail: nathajoy@gmail.com
Mob: 9433802339