Posted on: May 23, 2024 Posted by: Editor Desk Comments: 1
লুখা নদী
Spread the love

               উত্তর পূর্ব ভারতের একটি রাজ্য মেঘালয়। এই রাজ্যের উত্তর-পূর্বদিকে আসাম ও দক্ষিণ দিকে বাংলাদেশ। চারিদিকে উচু পাহাড়, অজস্র ঝর্না, স্বচ্ছ জলের হ্রদ, এর সাথে নীল মেঘের হাতছানি সব মিলিয়ে রাজ্যটিকে স্বপ্নের দেশ বলে মনে হয়। গারো, খাসিয়া,ও জয়ন্তিয়া পাহাড় গুলি এই রাজ্যের মূল আকর্ষণ। এই রাজ্যের এক-তৃতীয়াংশ পর্বত ও বনভূমি দ্বারা আবৃত। যে কারণে বার্ষিক ১২০০ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত এখানে হয়। প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্ট বনভূমি নদীও ঝর্ণার প্রাচুর্যের কারনে, অসংখ্য বন্য প্রাণীর দেখা মেলে এখানে। গারো খাসিয়া ও জয়ন্তী পাহাড় জীব বৈচিত্র ও বাস্তুতন্ত্রের এক বিরাট আঁধার। এখনো পর্যন্ত পৃথিবীতে অস্তিত্ব পাওয়া বহু জীব ও বন্যপ্রাণের খোঁজ এই অঞ্চলে প্রথম পাওয়া যায়।

             তবে বর্তমানে এই অঞ্চল গুলি, দিনে দিনে কর্পোরেটদের কাছে মুক্ত অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। নদী ও পাহাড় গুলি কে তারা তাদের ব্যবসার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করছে। ফলে বন ও বন্যপ্রাণী, এবং জঙ্গলের গভীরে থাকা আদিম জনজাতি রাও বিপন্ন হয়ে পড়েছে। ভয়ানক দূষণ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ঢুকে পড়ছে প্রতিবেশী দেশে ও। প্রশাসন এ ব্যাপারে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে বহুদিন থেকেই। কর্পোরেট দের কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া এমন একটি স্বীকৃতিহীন আন্তর্জাতিক নদী লুখা (ভারত ও বাংলাদেশ) মেঘালয়ে ভারত সীমান্তের লুখা নদী লোভা নামে বাংলাদেশের সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার পূর্ব লক্ষীপ্রসাদ ইউনিয়ন দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। (কানাইঘাট উপজেলার পশ্চিম দিঘীরপাড় ইউনিয়নের চড়ুই পাড়া গ্রাম অব্দি প্রবাহিত হয়ে সুরমা নদীতে মিশেছে।) গারো ও জয়ন্তী পাহাড় জুড়ে অবৈধ কয়লা খনি, চুনাপাথর উত্তোলনের দৌরাত্ম্য মারাত্মক হারে বেড়েছে। মাইলের পর মাইল জঙ্গল সাফ করে অজস্র খনি আর সিমেন্ট ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছে। বলা যেতে পারে বর্তমানে ভারতবর্ষের এক-তৃতীয়াংশ চুনাপাথর, বক্সাইট, ডলোমাইট, কয়লা, এই অঞ্চলে পাওয়া যায়। এই প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যের কারণে অজস্র সিমেন্টের কারখানা, বৈধ এবং অবৈধ অজস্র মাইনিং কোম্পানি গজিয়ে উঠেছে এই অঞ্চলে। জঙ্গলে তাদের একচ্ছত্র অধিকার দিয়েছে সরকার।

গারো ও খাসি পাহাড়ে অবৈধ খনিজ উত্তোলন চলছে। যার ফলে এরকম অসংখ্য নদী দূষণে জর্জরিত।

                 মেঘালয়ের সোনাপড়ডি গ্রামটি লুখা নদীর তীরে অবস্থিত। বেশ সমৃদ্ধশালী গ্রামে এটি নদীকে কেন্দ্র করেই এই গ্রামের অর্থনীতি, শিক্ষা,জীবন- জীবিকা, সংস্কৃতি সব কিছুই আবর্তিত হত। তবে বর্তমানে ভয়াবহভাবে এই নদীর দূষণ বেড়ে যাওয়ায় সোনাপরডির মত জয়ন্তী পাহাড়ের বহু আদিম জনজাতির অস্তিত্ব আজ সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। সোনাপরডি গ্ৰামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া লুখা নদীর উপরে রয়েছে নারপো ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি, এর প্রায় ৪০প্রকারের স্তন্যপায়ী প্রাণী ও সরীসৃপ সরাসরিভাবে লুখার উপর নির্ভরশীল বিশেষত leopard cat, clouded leopard, sloth, Hulk gibbon, slow loris, Red Panda IUCN(international Union for conservation nature) এর তালিকায় থাকা বিপন্ন থেকে অতি বিপন্ন প্রাণীরা আছে এই অরণ্যে। সোনাপরডি গ্রামের কাছে লুখা নদীর পাড়ে দাঁড়ালে, চোখে পড়বে কাঁচের মতন নীল স্বচ্ছ জলরাশি। এ নদীর জল এতটাই স্বচ্ছ যে প্রায় ৮-১০ফুট গভীরে থাকা ক্ষুদ্র পাথর ও বালুকণাও পরিষ্কার হবে দেখা যায়। কিন্তু বর্তমানে লুখা নদীর শাখা প্রশাখা ধরে যতই ওপরের দিকে যাওয়া যাবে, নদীর জল ততই গাড়ো নীল বর্ণের এবং বিষাক্ত অ্যসিড গন্ধ যুক্ত।

              কয়লা ও সিমেন্ট ফ্যাক্টরির দূষণে মারাত্মকভাবে দূষিত। এই নদীর উপরের দিকে অসংখ্য কয়লা, চুনাপাথর খনি, এবং সিমেন্ট ফ্যাক্টরি র যাবতীয় দূষিত বর্জ্য মিশছে এই নদীতে। নদীর উপরিভাগের এই দূষণ গোটা নদীতে ছড়িয়ে পড়ে নদীকে কার্যত জলজপ্রানী শূন্য করে দিয়েছে। প্রতি বছর শীতের শুরুতেই এই নদীর জল গাড়ো নীল বর্ণের হয়ে যায়। সাথে তীব্র অ্যাসিডিক গন্ধে ভরে ওঠে নদীর তীরবর্তী অঞ্চল গুলি। ভয়ঙ্কর দূষিত এই জল ভারতের সীমান্ত ছাড়িয়ে প্রবেশ করে বাংলাদেশেও।

খনিজ শোধনের ফলে লুকা নদীর জল বিষাক্ত ও জলজ জীব শূন্য হয়ে পড়েছে।

               সরকারের কাছে বারবার আবেদন করা সত্বেও এ অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। নুরপু এলাকার খাসি ছাত্রসংগঠন জানাই ২০০৪-২০০৬ সালে থ্যাংস্কাই ও লুমস্নং এ দুটি বৃহত্তম সিমেন্ট কারখানা (Top sem, Star cement) তৈরি হয় এরপর ২০০৭ সাল থেকেই লুখার জল নীল হয়ে উঠতে শুরু করে। পাশাপাশি কানাইঘাটে চলছে বড় বড় পাথর খাদান, চুনাপাথর ও কয়লা খনি। তাদের দাবি থ্যাংস্কাই ও লুমস্নং এলাকায় থাকা অজস্র সিমেন্ট কারখানা ও খনির দূষণ ই এই বিষক্রিয়ার জন্য দায়ী। সমীক্ষায় দেখা গেছে জলে অম্লতা অত্যাধিক ক্যালসিয়াম ফসফেট এর মাত্রা ভীষণভাবে বেশি। দূষিত এই জল নদী ও নদী তীরবর্তী অঞ্চলে একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলেছে।IUCN এর অতি বিপন্ন তালিকায় থাকা গোয়ালপাড়া লোচ্ মাছটি একেবারে হারিয়ে গেছে।IUCN এর সমীক্ষায় বলা হয়েছে ২০০৯ সালের ২৫শে মার্চ বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলায় সর্বশেষ এই মাছটিকে দেখা গেছিল। লুখা নদী লুভা নাম নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে সুরমা নদীতে মিশেছে। হলে প্রতিবেশী দেশ থেকে বয়ে আনা ওই বিষাক্ত জল সুরমা নদীর জীব-বৈচিত্র কেও মারাত্মক ভাবে বিপন্ন করে তুলেছে। এই লুখা নদীর বেশ খানিকটা উপরে দিকে খার্দুম গ্রামে রয়েছে মার গোত্রের আদিম উপজাতি। আরমাত্র ৫৫ টি পরিবারে ৪২৬ জন আছেন এই গোষ্ঠীতে। এদের জীবন মূলত এই নদীকেন্দ্রিক, বর্তমানে নদীর বিপন্নতার সাথে সাথে এই জনজাতি ও ভয়ঙ্কর বিপদের সম্মুখীন। তারা ধীরে ধীরে গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছে শহরে। আসাম, গৌহাটি, শিলং, প্রভৃতি অঞ্চলে। সেখানে হোটেলে, গাড়ি চালিয়ে বা মহিলারা বাড়ির পরিচারিকার কাজ করে এখন জীবীকা নির্বাহ করছেন। এই নদী ই একদিন আদিম জনজাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে যেমন করে লালন পালন করেছিল, ঠিক তেমনভাবেই আজ তাদের বাস্তুহারা করছে।

নদীর উপর নির্ভরশীল এরকম অসংখ্য জনজাতির বাসভূমি ও নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছে

               শুধু লুখা নয় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হীন মিন্ত্রা নদী, লালাখাল ভয়াবহ দূষণের কবলে বিপর্যস্ত। এ দুটি নদীর বিষাক্ত রাসায়নিক, ও জল বাহিত দূষণ সুরমা নদীতে মিশেছে। বিক্রি হয়ে যাওয়া এই নদী শুধুমাত্র গোয়ালপাড়া লোচ্ মাছকেই বিলুপ্ত করে নি। বিলুপ্ত করেছে সেই কোন প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে এই পাহাড়ের কোলে আশ্রয় নেওয়া অজস্র উদ্ভিদ প্রাণী ও জীবজগৎ কে। বিপন্ন করেছে গারো,ও খাসিয়া পাহাড়ের বহু আদিম জনজাতির ভাষা, সংস্কৃতি, ও জীবন-জীবিকাকে। বিপন্ন করে তুলেছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পরিবেশকে ও। সর্বোপরি বিপন্ন করেছে আমাদের মনুষ্যত্বকে।

 

লেখক: অনুপ হালদার , নদী গবেষক ও নদী কর্মী,
e.mail : bigyanannesak1993@gmail.com হোয়াটসআপ 9143264159


Spread the love

1 people reacted on this

  1. অত্যন্ত সুন্দর একটি লেখা, এরকম আরো লেখা পড়তে চাই।
    অনেক ধন্যবাদ লেখককে।

Leave a Comment