Posted on: May 20, 2024 Posted by: Editor Desk Comments: 0
Spread the love

 

আমাদের স্কুল পাঠ‍্যে ইংরেজী বিষয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা একটি গল্পের অংশ পড়ানো হত । গল্পের ঐ অংশের নাম ছিল The Last Lesson । গল্পটা এই রকম ফরাসি দেশের একটি শহরের স্কুলে ক্লাস শুরু হয়েছে সকাল দশটায় । স্কুলের একটি বছর দশেকের ছাত্র ধরা যাক ছাত্রটির নাম এন্টনি । তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালীর ছোটবেলার অপুর মত । সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের । জার্মানরা ফ্রান্স দখল করেছে । যে দিনের কথা হচ্ছে সেদিনটি ছিল রৌদ্রকরোজ্জ্বল । সুন্দর আবহাওয়া । চারপাশে সবুজের সমারোহ । পাখিদের কল কাকলী বাতাস মুখরিত করে রেখেছে । এমন দিনে এন্টনির মন নদীর ধারে, পার্কে, ঝোপঝাড়ে প্রজাপতির পেছেনে ছুটে যেতে চাইছিল । মনটা খুশিতে ভরা ছিল । তবুও স্কুলে যেতে হবে । একটু দেরি করেই ক্লাসে পৌঁছাল সে । মাষ্টার মশাই তাকে কিছু বললেন না । এন্টনি মাথা নীচু করে নিজের জায়গায় গিয়ে বসে পড়লো । তার সতীর্থরা এবং মাষ্টার মশাই সবাই চুপ করে আছেন । সবার মুখই গম্ভীর । ব্ল‍্যাক বোর্ডে মাষ্টার মশাই লিখে রেখেছেন ‘ ভি বা লা ফ্রান্স’ আমাদের মাতৃভাষা ফরাসি দীর্ঘজীবী হোক । এবার মাষ্টার মশাই ধীরে ধীরে বললেন যে জার্মানরা আমাদের দেশ দখল করে নিয়েছে । জার্মান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে আগামীকাল থেকে পঠন পাঠন হবে জার্মান ভাষায় । মাতৃ ভাষায় আজকেই তোমাদের শেষ পাঠ পড়াব । আগামীকাল থেকে তোমাদের জার্মান ভাষায় পড়াশুনা করতে হবে । এন্টনি ভাবে তা হলে কাল থেকে কি আমাকে সব কিছু জার্মান ভাষায় ব‍্যক্ত করতে হবে । এই যে গাছপালা, পশু পাখি, নদী প্রান্তর , বন্ধু বান্ধব যাদের সাথে আমি কথা বলি সব জার্মান ভাষায় বলতে হবে । ছাদের আলসেতে যে কপোত কপোতি বক বকুম করছে তাদেরকেও জার্মান ভাষায় বক্ বকুম করতে হবে ? এন্টনি ভেবে পায়না মানূষের মুখের ভাষা কি এভাবে কেড়ে নেওয়া যায় ?

মানুষের ভাষা তৈরি করে তার পরিবেশ । এই পরিবেশের প্রথম স্থানে রয়েছেন তার মা । তারপর আসে পরিবার, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধু বান্ধব, স্কুল । শহর, জেলা, রাজ‍্য এবং দেশ আসে একের পর এক । মাতৃপরিবেশে বেড়ে ওঠা মানুষ মায়ের মুখের ভাষাই রপ্ত করে বেড়ে ওঠার সাথে সাথে । এভাবেই তৈরি হয় এক একটি জন গোষ্ঠীর ভাষা । আবার এক একটি ভাষার মধ‍্যে থাকে অনেক বৈচিত্র্য বা বিবিধতা । কিন্তু পঠন পাঠন এবং সরকারি কাজ কর্মের জন‍্য ভাষার একটা নির্দিষ্ট রূপ ব‍্যবহার করা হয় যে রূপটি একটি বৃহৎ অঞ্চলের বিভিন্ন জনগোষ্টির কাছে গ্রহণযোগ্য । যখনই একটি ভাষার গ্রহণযোগ‍্য রূপ পাল্টে অন‍্য একটি ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হয় তখনই ওঠে প্রতিবাদের ঝড় । গড়েওঠে মাতৃভাষা রক্ষা করার আন্দোলন । মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষা রকরার জন‍্য দুটি আন্দোলন হয়েছে । একটি ১৯৫২ সালে তদানীন্তন পূর্বপাকিস্থানে অন‍্যটি ১৯৬১ সালে স্বাধীন ভারতবর্ষের একটি অঙ্গরাজ্য আসামের বরাক উপত‍্যকায় । ১৯৫২ সালের আন্দোলনে পূর্বপাকিস্থানের রাজধানী ঢাকা শহরে শহীদ হন পাঁচজন ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখ । আসামের বরাক উপত‍্যকার ভাষা আন্দোলনে ১৯৬১ সালের ১৯শে মে তারিখ শহীদ হন ১১জন । পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলনের ফলে

পূর্ব পাকিস্তান একটি আলাদা রাষ্ট্র বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়েছে ১৯৭১ সালে । ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর আরও একবার লক্ষ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছেন । ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটি বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি পয়েছে । ১৯৬১ সালের ভাষা আন্দোলনের জন‍্য আসাম সরকার তাদের চাপিয়ে দেওয়া ভাষা প্রত‍্যাহার করে নিতে বাধ‍্য হয় । তবে অসমীয়া ভাষা স্কুলে পাঠ‍্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে । বরাক উপত‍্যকায় অসমীয়া ভাষা শিক্ষকের পদ সৃষ্টি হয়েছে । অনেক ছেলে মেয়ে অসমীয়া ভাষা শিক্ষক পদে নিযুক্ত হয়েছেন ।

ইতিহাসের পাতা ওল্টালে আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন দেশের মানুষ তাদের ভাষার জন‍্য লড়াই করেছেন এবং এখনও করে চলেছেন । আমাদের পড়শী দেশ শ্রীলঙ্কা এবং নেপাল অথবা ইউরোপের স্পেন এবং চেক গনতন্ত্রে ভাষাকে ব‍্যবহার করা হয়েছে মানুষকে অবদমিত করে রাখার জন‍্য । কিন্তু মানুষ তাদের নায্য দাবী আদায় করার জন‍্য আন্দোলন করেছেন । শ্রীলঙ্কার তামিলরা তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার জন‍্য ২৬ বছর ধরে লড়াই করেছেন । একটা রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েন শ্রীলঙ্কার তামিলরা । মধ‍্যপ্রাচ‍্যে কুর্দিদের ভাষার জন‍্য লড়াই সারা পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে । ১৯৮৮সালে ইরাকে কুর্দিদের গনহত‍্যা করা হয়েছে । তুরস্কে কুর্দি ভাষার উপর নিষেধাজ্ঞা গোষ্টি দ্বন্দ্বে পরিনত হয়েছে । ইউরোপের চেকশ্লোভাকিয়া চেক এবং শ্লোভানিয়া দুটি ভাষাগোষ্ঠিতে বিভক্ত । ভাষা একটি শক্তিশালী মাধ‍্যম একটা আন্দোলন গড়ে তোলার জন‍্য । কোন জনগোষ্ঠীর ভাষা হারিয়েগেলে সেই জনগোষ্টিও হারিয়ে যায় ।

আমাদের ভারতবর্ষ একটি বহুভাষিক রাষ্ট্র । ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ‍্যে ভাব আদান প্রদানের অসুবিধা হয় । তার জন‍্য শাসক দল চেষ্টা করে একটা সাধারণ ভাষা সবার রোজকার কাজ কর্মের জন‍্য ব‍্যবহার করতে । ভারতের সরকারি ভাষা হিসাবে হিন্দিকে বাছা হয়েছে । কিন্তু সবাই সেটা মানতে রাজি নয় । দক্ষিণ ভারতের চারটি ভাষা জনগোষ্ঠী তেলেগু, তামিল, কন্নড় এবং মালায়ালিরা হিন্দির বিপক্ষে । দক্ষিণ ভারতের চারটি ভাষাই প্রাচীন এবং অত‍্যন্ত সমৃদ্ধ । তাই ভাষা নিয়ে মতান্তর এবং বিরোধ মাঝে মাঝেই প্রকট হয়ে ওঠে । মাতৃ ভাষায় কথাবলা এবং শিক্ষা লাভ করার অধিকার সকলের রয়েছে । কিন্তু গোটা ভারত জুড়েয়েই প্রাথমিক মাধ‍্যমিক এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজী ভাষাকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে যে ভাষা বৃটিশরা আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়ে প্রায় দুশো বছর আমাদের শাসন এবং শোষণ করেছে । যেকোনো ভাষা শিক্ষায় আমাদের আপত্তি থাকা উচিৎ নয় । কারণ এখন আমরা বিশ্ব গ্রামের Global Villageএর বাসিন্দা । কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব‍্যবস্থায় বাংলা মাধ‍্যমের স্কুল গুলির দশা দিনের পর খারপ হচ্ছে । তেমনি বাড়ছে ইংরেজী মাধ‍্যমের স্কুলের রমরমা । মানুষ নিজের সাধ‍্যের বাইরে গিয়েও ছেলে মেয়েদের ইংরেজী মাধ‍্যমে লেখা পড়া করাচ্ছেন । ২১ফেব্রুয়ারি বা ১৯মের শিক্ষা হলো আমাদের মাতৃভাষার প্রতি আগ্রহী করে তোলা । মাতৃভাষাকে দূরে সরিয়ে রেখে কোন শিক্ষাই সম্পূর্ণ হতে পারেনা ।নিজেদের সভ‍্যতা ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বেঁচে থাকা যায়না । বিদেশে বসবাস করা বাঙ্গালীরা কথাটা ভীষণভাবে অনুভব করতে পরছেন । তাই আপ্রণ চেষ্টা করছেন পরবর্তী প্রজন্মকে নিজেদের ভাষা, সভ‍্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী করে তুলতে ।

————————————————————————————————————————————————————————————————

অজয় নাথ

বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান লেখক

 


Spread the love

Leave a Comment