Posted on: May 13, 2024 Posted by: Editor Desk Comments: 0
Spread the love

 

[গঙ্গার দু’ধারে বিস্তীর্ণ পাটশিল্পকে নিয়ে রাজনৈতিক তরজা অব্যাহত। কিন্তু প্রশ্ন একটাই, বিগত বছরগুলিতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা পাট-শ্রমিকদের দুর্দশা মোচনে কী করলেন?]

গোড়ার কথা

অবিভক্ত বাংলায় যে শিল্পগুলি প্রধান সারিতে ছিল তাদের অন্যতম হল পাট শিল্প। গোটা দক্ষিণ এশিয়াতে পাট পাওয়া গেলেও অবিভক্ত বাংলায় (ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ) পাটের রমরমা ছিল সবচেয়ে বেশী। মূল কারণ নদীমাতৃক বঙ্গদেশের পরিবেশ পাটচাষের পক্ষে সবচেয়ে উপযোগী ছিল, ফলে ভারতবর্ষে ব্যবসা করতে আসা ব্রিটিশরা আজ থেকে ১৫০ বছর আগে পাট শিল্পের পত্তন করেন এবং তখন থেকেই পাটের তৈরী ব্যাগ সব ধরনের জিনিষ এমনকি খাদ্যশস্য সারা পৃথিবীতে পাঠানোর জন্য ব্যবহৃত হত। পাট শিল্প বাঙালী জনজীবনের এক অন্যতম সম্পদ। পাট শিল্পকে আশ্রয় করে যুগ যুগ ধরে গড়ে উঠেছে এক বিশেষ আর্থ সামাজিক পরিবেশ, যা বাঙালীর বহমান ইতিহাসের অন্যতম সঙ্গী। বাংলার সাহিত্যে বাঙালীর মননে পাটশিল্প এক বিশেষ মূলধন, যার উপর দাঁড়িয়ে আছে বাঙালীর অর্থনৈতিক জীবনের ভারসাম্য।

ইংরেজ আমল থেকে সামন্ততান্ত্রিক কৃষি ব্যবস্থাতে কৃষক ছিল জমিহীন ক্ষেত-মজুর। জমিদারের অত্যাচারে প্রায়শই ক্ষেত মজুররা গ্রাম ছাড়া হত আর তাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল নবনির্মিত চটকল। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মহেশ নামক ছোট গল্পটি তার এক অনন্য উদাহরণ। সর্বস্বান্ত রহমৎ গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়ে তার ছোটমেয়ে আমিনার হাত ধরে উলুবেড়িয়ার চটকলের দিকে পা বাড়িয়ে ছিল, কেবলমাত্র বেঁচে থাকার জন্য। এইভাবে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, উড়িষ্যা ও সুদূর দক্ষিণ থেকেও জমিহীন কৃষক কাজের সন্ধানে চটকলে শ্রমিকে পরিণত হত। চটকলে কাজ করে সর্বসান্ত কৃষকরা সর্বহারা শ্রমিকে পরিণত হত। তাদের না আছে কোন ভবিষ্যত, না আছে বেঁচে থাকার সুখ।

ইংরেজ আমলে জুট শ্রমিকরা তাদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত করেছিল এবং তদানীন্তনকালে শ্রমিকদের না ছিল সঠিক মজুরি বা অন্যান্য অবসরকালীন কোন সুযোগ সুবিধা। ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বারবার জুট শ্রমিকরা ধর্মঘট করে তাদের প্রতিবাদ চিহ্নিত করেছিল। ১৯৩৭ সালে জুট শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য মজুরি ও অন্যান্য দাবীর ভিত্তিতে ধর্মঘট করে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২৪ পরগণার খড়দায় থাকাকালীন সময়ে স্বচক্ষে জুট শ্রমিদের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। জুট শ্রমিকদের ধর্মঘটের বিষয় নিয়ে ২১শে এপ্রিল ১৯৩৭ সালে হিন্দু পত্রিকায় শ্রমিকদের স্বপক্ষে লিখলেন – ‘It has deeply grieved me to learn of the suffering of hundreds of thousands of jute workers who have struck work science February last. This causes misery not only to the workers themselves but also to their women and children. The demands for higher wages and for humane conditions of work are just and reasonable.’ তিনি সেদিন দাবী করেছিলেন Organizations যেন পীড়নের বদলে কল্যাণে মন দেয়। Humanity demands that those who bear the burden of society should be protected and looked after by society itself. শ্রমিকদের অসহনীয় দুর্দশার পরিবেশ জেনে দেশবাসী যেন তাদের পাশে এসে দাঁড়ান। আর আশা করেছিলেন, এই ন্যায্য শ্রমিক আন্দোলনে ফাটল ধরাতে, শাসক-প্রশাসক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর বিচ্ছেদের খেলা থেকে যেন বিরত থাকেন। ‘To give this strike a communal turn by stirring up ugly communal passions should be condemned by every right – Thinking man’,

দেশভাগ

বলা বাহুল্য, অবিভক্ত বাংলায় পাট ব্যবসা ছিল খ্যাতনামা। দেশভাগের পর এরাজ্যেও পাট উৎপাদনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। বছরে গড়ে ৮০ থেকে ৮২ লক্ষ বেল পাট উৎপাদিত হয় এ রাজ্যে। মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, উত্তর ২৪ পরগণা, মালদা, জলপাইগুড়ি, দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার, দার্জিলিং ও হাওড়া জেলার কিছু অংশে পাট চাষ হয়। ৪০ লক্ষ মানুষ পাট চাষের সঙ্গে যুক্ত। বিদেশী মুদ্রা অর্জনে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের বিপুল চাহিদা।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে ব্রিটিশ আমলে পাট চাষ হত মূলত বাংলাদেশে, কিন্তু চটকলগুলি স্থাপিত হয়েছিল অধুনা পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গার অববাহিকায়, মূলত দক্ষিণবঙ্গে। দ্বিখণ্ডিত স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে পাট চাষ আরম্ভ হয় এবং বহু জায়গাতে কৃষকরা পাট চাষ করে অর্থ উপার্জনে সক্ষম হয়। ফলত পশ্চিমবঙ্গের কৃষি ব্যবস্থায় বিশেষ পরিবর্তন আসে এবং রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার চটকলগুলির স্বার্থে কৃষককে পাট চাষের জন্য উৎসাহিত করে এবং পরবর্তী ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে জুট কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া গড়ে ওঠে যার মূল লক্ষ্য ছিল জুট শিল্পকে আরও উন্নত পর্যায়ে উন্নীত করা কারণ ভারতবর্ষের বিদেশী মুদ্রা অর্জনের অন্যতম বিষয় ছিল পাট রপ্তানী।

বলা বাহুল্য সারা বিশ্বে স্বীকৃত চট ও ফাইবার বায়ো-ডিগ্রেডেবল ও পরিবেশবান্ধব। একথা সকলেরই জানা আছে যে চটশিল্প জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে যে এটা কৃষিভিত্তিক শিল্প (Agrobased), শ্রমনিবিড়, বায়ো-ডিগ্রেডেবল ও পরিবেশবান্ধব এবং রপ্তানীযোগ্যও বটে। এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ৪০ লক্ষ পাটচাষী ও ২.৫০ লক্ষ শ্রমিক, স্বনিযুক্তি হস্তশিল্পী এবং পরোক্ষ্ভাবে আরও বহু শ্রমজীবি মানুষ এর উপর নির্ভরশীল এ রাজ্যে। আমাদের রাজ্য ছাড়াও পূর্ব ও উত্তর পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের বহু মানুষ এ ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত।

সারা দেশে Composite Jute Mill হচ্ছে ৮৩টি। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ৬৪টি, বর্তমানে তার মধ্যে ৫৯টি চালু আছে। অস্ত্রপ্রদেশে ৭টি, বিহারে ৩টি, উত্তর প্রদেশে ৩টি, আসামে ২টি, উড়িষ্যায় ১টি, ছত্রিশগড়ে ২টি, ত্রিপুরায় ১ টি। দেশের নানা জায়গায় ছড়িয়ে থাকা ৮৩টি চটকলে চটের উৎপাদনের পরিমাণ ২০ লক্ষ ৫০ হাজার টন। এই বিপুল উৎপাদনের মধ্যে সাকুল্যে গৃহস্থ জীবনে ব্যবহৃত হয় ২ লক্ষ ৪০ হাজার টন চট। তাছাড়া প্রতিবছর গড়পড়তা ৮০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টন চট বিদেশে রপ্তানী হয়। পড়ে থাকা ১৭ লক্ষ টন চট জুট প্যাকেজিং আইনের মাধ্যমে রেশনে খাদ্যদ্রব্য বন্টন ও চিনির প্যাকিং-এ ব্যবহৃত হওয়ার কথা।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, ইতিমধ্যে সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি সর্বসম্মতভাবে সুপারিশ করে বলেছে যে ১৯৮৭ সালে “The Jute Packaging Materials (Compulsory Use in Packaging Commodities) Act 1987” কে Dilute না করে আইনটি হুবহু কার্যকর করতে। সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি ১৬তম লোকসভায় সর্বসম্মত সুপারিশে বলা হয়েছিল যে “The committee appreciate that a number of measures are being taken to redress the problem of the jute industry workers and jute growers. In view of the fact that jute is one of the important foreign exchange earners and all over the word only India and Bangladesh are producing jute, the Committee impress upon the Ministry to continue according greater attention to this sector so as to effectively safeguard the interest of the jute workers and growers and promote the jute industry in a big way and not to dilute the provision of reservation as contained in: “The Jute Packaging Materials (Compulsory Use in Packaging Commodities) Act 1987.

জুট শ্রমিকদের অন্তহীন দুর্দশা অব্যাহত

পশ্চিমবঙ্গে চট শিল্প এক গভীর বিপন্নতায় আক্রান্ত। প্রত্যেক দিনই খবরের কাগজ খুললেই চটকল বন্ধের খবর পাওয়া যায়। হাজার হাজার জুটমিল শ্রমিক তাদের আইনি প্রাপ্য পাচ্ছেন না। জুটমিলের মালিকরা ক্রমাগত তাদের লোকসানের গল্প তৈরি করে শ্রমিকদের সঠিক পাওনা আত্মসাৎ করে চলেছে। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার সম্পূর্ণ উদাসীন। ১৯৮৭-র পর থেকে প্রায় দু-দশক কেন্দ্রীয় সরকার প্রায় ৪০ শতাংশ চাল, গম, চিনির মত খাদ্যবস্তু চটের ব্যাগে প্যাকিং করা আবশ্যক করলেও দ্বিতীয় UPA সরকার পরিমাণটিকে ২০ শতাংশ নামিয়ে এনেছে। মনে হচ্ছে যে পাট শিল্প সরকারের আসীন নেতা নেত্রীদের সমর্থন হারিয়েছে। রাজ্য এবং দেশের সামগ্রিক পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে অবস্থানটি যে মোটেই অনুকূল নয় তা বলাই বাহুল্য। পাটকলের মালিকরা ক্রমাগত তাদের লোকসানের গল্প তৈরি করে শ্রমিকদের সঠিক পাওনা আত্মসাৎ করে চলেছে। রাজ্য ও কেন্দ্রিয় সরকার সম্পূর্ণ উদাসীন। পাটকল মালিকরা ভারত সরকারের কাছ থেকে চটের বস্তা তৈরির অর্থমূল্য কী হবে সেটিও ভারত সরকার ঠিক করে দেয়। এই মূল্যের মধ্যে শ্রমিকদের মাইনে এবং অন্যান্য আর্থিক সুবিধার হিসের ধরা থাকে। এক্ষেত্রে অবসরের পর শ্রমিকদের প্রাপ্য টাকা না দেওয়ার একটাই অর্থ করা যায় যে, পাটকল মালিকেরা ইচ্ছাকৃতভাবেই তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বেআইনি ভাবে বঞ্চিত করছে। এমনকী সুকৌশলে শ্রমিকদের অবসর সংক্রান্ত সামাজিক সুরক্ষার বিধি এড়াতে মালিকেরা ঠিকা কর্মী নিয়োগ করছে। এর উদ্দেশ্য একটাই যে এই ধরনের অস্থায়ী শ্রমিকদের বেলায় অবসর সংক্রান্ত দেনাপাওনার কোন ঝামেলা থাকে না। কারখানার অভ্যন্তরে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও পেশাগত রোগের সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯৪৮ সালে প্রণীত কারখানা আইনের কোনরকম কার্যকারিতা নেই। জুটমিলে সবথেকে বেশী শ্রমিক নানা ধরনের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন। জুট শিল্পের জন্মলগ্ন থেকে শ্রমিকরা বঞ্চনার শিকার আজও সেই পরিস্থিতি অব্যাহত। ১৯৩৭ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রমিকদের দুর্দশার বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ করেছিলেন, স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরেও সেই পরিস্থিতি আজও বর্তমান।

ভারতবর্ষ স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত। কিন্তু জুট শ্রমিকদের দুর্দশা অব্যাহত। রাজ্যে চটকলের শ্রমিকদের পক্ষ থেকে চন্দননগরস্থিত লিগাল এইড সেন্টার, সবুজের অভিযান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় রাষ্ট্রপতি সহ রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী ও কেন্দ্রের বস্ত্রমন্ত্রীর কাছে চটশিল্পের সঙ্কটের কথা জানিয়েছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য। কিন্তু উত্তর মেলেনি। এদের কাছ থেকে উত্তর না আসলে তবে কি আন্দোলন থেমে থাকবে? এই প্রশ্ন আজ পশ্চিবঙ্গের ৮০ লক্ষ মানুষের কাছে এক জ্বলন্ত জিজ্ঞাসা। হয়ত এই জ্বলন্ত জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে উঠে আসবে এক নতুন ভাবনা, যে ভাবনা হয়তো আজ ছোট আকারে দিকচক্রবালে দেখা দিয়েছে, এই ভাবনাই হয়তো আগামীদিনে নতুন আন্দোলনের সংকেত বহন করে আনবে।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: শ্রী অরুণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক ও পরিবেশ স্থপতি।

ছবি সৌজন্য : গুগল

বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়, পরিবেশ ও সমাজ কর্মী, চলভাষ- ৮৪২০৫২৯৯৬৬।


Spread the love

Leave a Comment