
কথামুখ
আর কিছুদিনের মধ্যেই বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তাদের পছন্দের সরকারকে বেছে নিতে ভোট দেবেন। নানান রাজনৈতিক দলও সরকার গড়তে নড়েচড়ে বসেছে। বিগত দিনগুলিতে কী কাজ করা হয়েছে, ক্ষমতায় এলে দেশ ও দশের জন্য আগামী দিনে কোন্ বিষয়গুলি গুরুত্ব পাবে, তার বিস্তারিত খতিয়ান তুলে ধরা হচ্ছে। প্রতিটি নির্বাচনেই যেমন হয় আর কি! পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়েও অনেক গালভরা কথা শোনা যায়। কিন্তু নির্বাচিত হয়ে সরকার গড়ার পর কেউই খুব একটা কথা রাখে না। প্রাকৃতিক সম্পদের অতি-ব্যবহার এবং দূষণের বিনিময়েও সরকারের কাছে আর্থিক বিকাশই তখন পাখির চোখ। মাথায় থাকে না প্রকৃতির সাথে এক অসম যুদ্ধে নেমে মানুষ ক্রমশ হেরেই চলেছে।

বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন আজ সত্য। আবহাওয়াজনিত নানান চরম ঘটনা বিভিন্ন দেশ ও তার মানুষকে করে তুলেছে বিপন্ন, অসহায়। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা-র ‘স্টেট অফ দ্য গ্লোবাল ক্লাইমেট রিপোর্ট ২০২৩’ জানাচ্ছে, উষ্ণতার এযাবৎ নথিভুক্ত তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সাল উষ্ণতম। সমুদ্রের জল এবং ভূপৃষ্ঠ দুয়েরই তাপমান আগের সমস্ত উষ্ণতাকে ছাপিয়ে গেছে। প্রাক্-শিল্পবিপ্লবকালীন (১৮৫০-১৯০০ গড়) অবস্থা থেকে বিশ্বের ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি গড় তাপমাত্রা ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ১.৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেশি ছিল। ভারতের আবহাওয়া দপ্তরও জানিয়েছে, ১২২ বছরের নথিভুক্ত সময়কালে ২০২৩ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাস উষ্ণতম ছিল। উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত ৩৩৪ দিনে ভারতে আবহাওয়াজনিত চরম ঘটনা ঘটেছে ২৯৬ দিন। এতে প্রাণ গেছে ৩২০৮ জন মানুষের। ২০.৯ লক্ষ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এরকম উদাহরণের সংখ্যা আর না বাড়িয়ে ভারতবর্ষে বিগত দশ বছরে পরিবেশের কয়েকটি দিকের কী হাল হয়েছে, তা এক নজরে দেখে নেওয়া যাক।
নদীস্বাস্থ্য
২০২২ সালে ভারতবর্ষের ৬০৩টি নদীকে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, এগুলির মধ্যে ২৭৯টি নদী (৪৬%) দূষিত। মহারাষ্ট্রে দূষিত নদীর সংখ্যা সর্বোচ্চ (৫৫টি)। গঙ্গা নদীর প্রবাহপথে সমীক্ষিত ৪৯টি স্থান অতি দূষিত। এরপরেই রয়েছে যমুনা (৩৫টি),গোদাবরী (৩১টি)। গঙ্গা নদীকে নির্মল করতে ২০১৪ সালে কেন্দ্র সরকার ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্পের মাধ্যমে ২০,০০০ কোটি টাকা খরচের ঘোষণা করে। প্রকল্পটি রূপায়নে বিস্ময়কর বিলম্ব হচ্ছে। বৈষ্ণব রাঠোর জানাচ্ছেন (১২.২.২৪), উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ড রাজ্য বাজেটে তাদের জন্য বরাদ্দ অর্থের মাত্র ৭% এ পর্যন্ত খরচ করেছে। গঙ্গা নদীকে নির্মল করার উদ্দেশ্যে যে পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রগুলি চালু হয়েছিল, তার ৭১% কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণে নদীতে আশঙ্কাজনকা মাত্রায় কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান মিলেছে যা নদীর জলে মানুষ ও পশুর মল-এর উপস্থিতি নির্দেশ করে।
১৮টি রাজ্য/কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে নদীর প্রবাহপথে সমীক্ষিত স্থানের জলে জৈব-রাসায়নিক অক্সিজেন চাহিদা ৩০ মি.গ্রা./লিটার (অনুমোদিত সীমার ১০ গুণ বেশি)। ২০১৯-২১ সালের মধ্যে এই সমস্ত নদীর প্রবাহপথে ১৯২০টি সমীক্ষিত স্থানের মধ্যে ৮১৭টি-র জল স্নানের অযোগ্য। ভারতে নদীর প্রবাহপথে অতি দূষিত ১০৯টি স্থানের মধ্যে উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে রয়েছে ২০টি স্থান (সর্বোচ্চ)। গঙ্গা সহ আরও ১১টি নদীর প্রবাহপথে দশটি বা তার বেশি স্থানে জৈব-রাসায়নিক অক্সিজেন চাহিদা ৩ মি.গ্রা./লিটার এর বেশি।
এযাবৎ কেন্দ্রীয় সরকার ৩০টি ‘সংযুক্তি প্রকল্প’ চিহ্নিত করলেও মাত্র একটি (মধ্যপ্রদেশে কেন-বেতোয়া সংযুক্তি প্রকল্প) চালু হয়েছে। সমালোচিত এই প্রকল্পের রূপায়নে ৯০০০ হেক্টর জমি তলিয়ে যাবে, যার মধ্যে পান্না বাঘ সংরক্ষণ কেন্দ্রের বাঘ ও শকুনের বাসভূমি রয়েছে।
বনভূমি ও বন্যপ্রাণী
কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক-এর (এমওইএফসিসি) তথ্য (৭ অগাস্ট ২০২৩ পর্যন্ত) থেকে জানা যাচ্ছে, ২০২২-২৩ সালে দেশজুড়ে ১৭,৩৮১.৮৮ হেক্টর বনভূমিতে অ-বনজ কাজকর্ম চালানোর জন্য বনভূমির চরিত্র বদল করা হয়। এই পরিমাণটি ২০২১-২২ সালে কৃত পরিবর্তনের থেকে ৩.৫ শতাংশ বেশি। ২০১৪-১৫ থেকে ২০২২-২৩ সাল পর্যন্ত ভারতের যে চারটি রাজ্যে বনভূমির চরিত্র সবচেয়ে বেশি বদলেছে, সেগুলি হল মধ্যপ্রদেশ (২৯,৮৯৫ হেক্টর, সমগ্র ভারতের ২১ শতাংশ), ওড়িশা (১৯,৫০৬ হেক্টর, সমগ্র ভারতের ১৩ শতাংশ), তেলেঙ্গানা (১১,০৫৫ হেক্টর, সমগ্র ভারতের ৮ শতাংশ) এবং গুজরাট (৯,৪০৯ হেক্টর, সমগ্র ভারতের ৭ শতাংশ)। উল্লেখ্য, ২০২২-২৩ সালে দেশজুড়ে যে ১৭৩৮১.৮৮ হেক্টর বনভূমির চরিত্র বদল করা হয়েছিল, তার প্রায় ৬৫ শতাংশ অঞ্চলই রাস্তা তৈরি, খননকার্য এবং ট্রান্সমিশন লাইন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা হয়। ভারতের ২৮টি রাজ্য এবং ৮টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে এই সময়ে মোট ৩২টি-তে বনভূমির চরিত্র বদলানো হয়। এগুলির মধ্যে ১৮টিতে ২০২১-২২ সালের তুলনায় এই পরিবর্তনের পরিমাণ বেড়েছিল।
২০২৩ সালে ‘বন সংরক্ষণ আইন, ১৯৮০’ সংশোধিত হয়। এতে বনের সংজ্ঞা এমনভাবে পাল্টে দেওয়া হল, যার ফলে ভারতের প্রায় ২৮% বনাঞ্চল আইনি রক্ষাকবচ হারাল। সম্প্রতি এমওইএফসিসি-র এক নয়া নির্দেশিকায় (১২.১০.২৩) রাজ্য বনদপ্তরগুলিকে উন্মুক্ত জঙ্গল, ঝোপঝাড়, পতিত জমি এবং অববাহিকা সহ ‘অবক্ষয়িত’ ভূমি চিহ্নিত করতে বলেছে, যা তাদের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবস্থাপনায় থাকবে। কেন এই নয়া নির্দেশিকা? না, এসব অঞ্চলে সবুজ আচ্ছাদন বাড়াতে দেশজুড়ে গাছ লাগানো হবে ‘গ্রিন ক্রেডিট’ সৃষ্টির জন্য। ‘গ্রিন ক্রেডিট’ কী? বলা হচ্ছে, কার্বন নিঃসরণ কমানো সহ নানান পরিবেশবান্ধব কাজে বাজারি উৎসাহদানের এক প্রচেষ্টা। বিশেষজ্ঞরা এই গ্রিন ক্রেডিট বিধিকে বনভূমির বাস্তুতান্ত্রিক দিক থেকে ‘সর্বনাশা’ ও ‘ক্ষতিকর’ এবং সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক বলে জানিয়েছেন। এই নির্দেশিকায় ‘অবক্ষয়িত’ শব্দটির অর্থ ও ব্যবহার নিতান্তই অস্পষ্ট এবং এর মাধ্যমে এসব অঞ্চলে কেবল কর্পোরেট বনসৃজন-এ উৎসাহ দেওয়া হল। এর ফলে এখানকার জমির গুণমান পাল্টাবে। স্থানীয় জীববৈচিত্র্য ধাক্কা খাবে এবং স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেন্দ্রের জারি করা গ্রিন ক্রেডিট বিধিতে তৃণভূমির নামও রয়েছে, যা বেশ কিছু একান্তভাবে স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতির বাসভূমি, যেমন- কৃষ্ণসার হরিণ। এই বিধির ফলে এরা অত্যন্ত বিপন্ন হয়ে পড়ল।
পৃথিবীর প্রথম আন্তর্মহাদেশীয় বন্যপ্রাণী স্থানান্তরের নজির গড়ে ভারত কুড়িটি আফ্রিকান চিতা নামিবিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ২০২২ এবং ২০২৩ সালে মধ্যপ্রদেশের ‘কুনো জাতীয় উদ্যান’-এ নিয়ে আসে। এদের মধ্যে সাতটি পূর্ণবয়স্ক এবং তিনটি শাবক মারা গেছে, যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে।
পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ
বিগত এক দশকে পরিবেশ সংক্রান্ত বিধিনিয়ম যতবার সংশোধিত হয়েছে, অতীতে তা হয়নি। ২৩ মার্চ, ২০২০ সালে এক খসড়া ‘এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) নোটিফিকেশন’-এ কোন পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই নানান প্রকল্প চালু করার অনুমতি দেওয়া হল পরিবেশের আইনি রক্ষাকবচগুলি শিথিল করে। দেশজুড়ে সমালোচনা ঝড় উঠল। কুড়ি লক্ষেরও বেশি মানুষ আপত্তি জানিয়ে নানান মন্তব্য ও প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠালেন। এই খসড়াটি বাস্তবায়িত হল না বটে, কিন্তু পরিবেশ মন্ত্রকের অফিস মেমোরান্ডাম এবং অর্ডারের মাধ্যমে বেশ কিছু ধারা চালু হল, বিশেষজ্ঞদের মতে যা খসড়া ইআইএ-র অনুলিপি মাত্র।
২০১৮-২২ সালের মধ্যে বন্যপ্রাণী, বনভূমি, পরিবেশ এবং উপকূলভাগ সংক্রান্ত ছাড়পত্রের সংখ্যা ২১ গুণ বৃদ্ধি পায় (৫৭৭ থেকে ১২,৪৯৬)। ২০১৪ সালে যেখানে কোন পরিবেশ ছাড়পত্র পেতে গড়ে ৬০০ দিন সময় লাগত, ২০১৭ সালে তা কমিয়ে ১৬২ দিন করা হয়। অতি দ্রুত ছাড়পত্র দিতে গিয়ে পরিবেশের উপর কী ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে, তা আলোচনার সময় কমে পরিবেশের ধ্বংস ত্বরান্বিত হল।
হিমালয়
ভারতের মোট ৮১টি বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ভূকম্পপ্রবণ হিমালয়ের কোলে ১২টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে অবস্থিত। এখানে আরও ২৬টি প্রকল্পের কাজ চলছে। উল্লেখ্য, ২০০৭-১৭ সালের মধ্যে এসব অঞ্চলে ১,১২১টি ভয়াবহ ধস নেমেছে (লাদাখ-এ ২৩টি, জম্মু ও কাশ্মীর-এ ২৩৮টি, উত্তরাখণ্ড-এ ২০৬টি, হিমাচল প্রদেশ-এ ১৭৭টি, অরুণাচল প্রদেশ-এ ৭২টি, সিকিম-এ ৫০টি, অসম-এ ৮৯টি, নাগাল্যান্ড-এ ৮৮টি, মেঘালয়-এ ৩৮টি, ত্রিপুরা-য় ৫টি, মিজোরাম-এ ৩৬টি এবং মনিপুর-এ ৯৯টি)। এমন বিপর্যয়ের পরেও আরও ৩২০টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হিমালয়ের কোলে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বায়ু দূষণ
২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের ২৪টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ১৩১টি শহরে ‘ন্যাশনাল ক্লিন এয়ার প্রোগ্রাম’ চালু করে। ২০২২ সালে অনুমিতা রায়চৌধুরী ও অভিকাল সোমবংশী-র এক প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, ১৩১টি শহরের পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রগুলির মাত্র ৬৯টিতে বাতাসের যথার্থ গুণমান মাপা হয়। মাত্র ১৪টি শহরে ২০১৯-২১ সালের মধ্যে বাতাসে ভাসমান সূক্ষ্মকণা (পিএম২.৫) ১০% বা তার কম নথিভুক্ত হয়েছে। ১৬টি শহরে পিএম২.৫ এর বৃদ্ধি দেখা গেছে।
ভারতবর্ষের প্রত্যেকটি বড় শহর বায়ু দূষণে আক্রান্ত। ২০২০ সালে বায়ু দূষণে ভারতের প্রায় ৫৯ কোটি মানুষের (মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৩.৪%) গড় আয়ু ৪ বছর ১১ মাস কমে গেছে। দিল্লিতে অতি দূষিত বায়ুর জন্য মানুষের গড় আয়ু কমার সংখ্যা সর্বোচ্চ। ভারতে বায়ু দূষণে বয়স্কদের তুলনায় শিশুরা বেশি আক্রান্ত। ২০১৯ সালে বায়ু দূষণে ভারতে পাঁচ বছরের কমবয়সী ১,৯৬,৭৭৫টি শিশুমৃত্যু ঘটেছে। এই ঘটনার ৬৪ শতাংশ ঘটেছে উত্তরপ্রদেশ, বিহার, রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশ এই চারটি রাজ্যে। ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২১ সময়ে দিল্লি সহ আরও অন্যান্য রাজ্য/কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে (মোট ১২টি) শিশুদের শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ মারাত্মক বেড়েছে।
এখনও ভারতের ৩৩.৮ শতাংশ গৃহস্ত বাড়িতে রান্নার প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে জ্বালানি কাঠ, কাঠের টুকরো বা শুকনো ফসলের অবশিষ্টাংশ ব্যবহৃত হয়। গ্রামাঞ্চলে এলপিজি গ্যাসের ব্যবহার বাড়লেও প্রায় ৪৭ শতাংশ বাড়িতেই উপরিউক্ত অপরিচ্ছন্ন জ্বালানি রান্নায় ব্যবহৃত হয়। অপরিচ্ছন্ন জ্বালানি ঘরের ভেতরে দূষণ ঘটায় যা শ্বাসকার্যে সমস্যা সৃষ্টি করে।
বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা
ভারতবর্ষের এমন একটি শহরও চিহ্নিত করা যাবে না যেখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়মমাফিক চলছে। ২০২০-২১ সালে ভারতে সৃষ্ট কঠিন পৌরবর্জ্যের পরিমাণ ছিল ১,৬০,০৩৯ টন, যার মধ্যে ৫০,৬৫৫ টনের কী গতি হয়েছিল, তা জানা যায় না। সাধারণত এইস
ব বর্জ্যকে বেআইনিভাবে পুড়িয়া দেওয়া হয় অথবা শহরের নিকাশী নালায় পড়ে সেগুলিকে বুজিয়ে দেয়। ফলত দূষণ বেড়ে চলে উত্তরোত্তর। ভারতে ১০টি রাজ্যে এরকম হিসাবহীন সর্বোচ্চ পরিমাণ বর্জ্যের দেখা মেলে, যার মধ্যে ৬টি রাজ্যই পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে। বিগত পাঁচ বছরে ভারতবর্ষে ক্ষতিকর বর্জ্য সৃষ্টিকারী শিল্পের সংখ্যা প্রায় ১৮% বেড়েছে। ফলত ক্ষতিকর বর্জ্যের পরিমাণ ৩১% বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২.৩৫ মিলিয়ন টন-এ। এমনকী, ২০২১-২২ সালে ভারতে আমদানিকৃত ক্ষতিকর বর্জ্যের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে।
নবীকরণযোগ্য শক্তি
২০১৫ সালে পৃথিবীর ১৪৪টি দেশে ট্রানজিশনাল ইলেকট্রিক গ্রিড-এর মাধ্যমে সৌরশক্তি সরবরাহের জন্য ৯৭টি ক্রান্তীয় দেশের মধ্যে ভারত এক ‘আন্তর্জাতিক সৌর জোট’ গঠন করে। এখনও অব্দি ভারত ও ফ্রান্স ছাড়া আর কোন দেশ এ’কাজে টাকা দেয়নি। জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী ভারত ২০২২ সালের মধ্যে ১৭৫ গিগাওয়াট নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদনের অঙ্গীকার করলেও নভেম্বর ২০২২ পর্যন্ত এই শক্তি উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১১৯ গিগাওয়াট। পৃথিবীর নানান দেশ প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী কতটা কথা রাখল, তা খতিয়ে দেখতে ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকার’ নামে যে পোর্টাল আছে, তার বিচারে ভারতবর্ষ হাইলি ইনসাফিশিয়েন্ট বলে চিহ্নিত হয়েছে (০৪।১২।২৩)। ২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ২০৭০ সালে ভারত নেট-জিরো কার্বন নির্গমনের লক্ষ্যে পৌঁছবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে হলে দেশের শক্তি চাহিদায় জীবাশ্ম জ্বালানি-নির্ভরতা ৭৩% (২০১৫) থেকে কমিয়ে ২০৫০ সালের মধ্যে ৫ শতাংশে আনতে হবে।
তাহলে
রাষ্ট্র সংঘ থেকে এই গ্রহটিকে বাঁচাতে ২০১৫ সালে ১৭টি ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য’ চালু হয়। উদ্দেশ্য ছিল ২০৩০ সালের মধ্যে সামগ্রিক উন্নয়নের ছাঁচে কোন দেশ পিছিয়ে থাকবে না। ১৬৬টি দেশের মধ্যে ভারতবর্ষ ১০০-এর মধ্যে ৬৩.৪৫ স্কোর নিয়ে ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য’ সংক্রান্ত রাষ্ট্রসংঘের প্রস্তুতি প্রতিবেদনে (২০২৩) ১১২তম স্থানে রয়েছে। ভারত নয়টি লক্ষ্য পূরণে বড়সড় চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল শূন্য ক্ষুধা (লক্ষ্য ২), সুস্বাস্থ্য ও সুস্থতা (লক্ষ্য ৩) এবং বিশুদ্ধ জল ও স্বাস্থ্যবিধান (লক্ষ্য ৬)। পরিবেশ দূষণ লক্ষ্য ৩ এবং ৬-কে সরাসরি প্রভাবিত করে। কর্মসম্পাদনের বিচারে দক্ষিণ এশিয়ায় আরও পাঁচটি দেশের স্থান ভারতের আগে, যেমন- ভুটান (৬১), মালদ্বীপ (৬৮), শ্রীলঙ্কা (৮৩), নেপাল (৯৯) এবং বাংলাদেশ (১০১)৷ কেবল পাকিস্তান (১২৮) এবং আফগানিস্তান (১৫৮) ভারতের পরে রয়েছে।
কেবল বিগত ১০ বছর নয়, ভারতবর্ষে পরিবেশের সচেতন নিধনযোগ্য আরম্ভ হয়েছিল ব্রিটিশদের সময় থেকেই। ভারতবর্ষ তথা বিশ্বজুড়ে রেলপথ পাতার জন্য যে কাঠের দরকার ছিল। তা খুঁজে পেয়েছিল ব্রিটিশরা ভারতের জঙ্গলে। তার ফলে ছোটনাগপুর ও বিন্ধ্য পর্বতমালার শাল গাছের জঙ্গল প্রায় সাফ হয়ে গেল। তাছাড়া, প্রাকৃতিক কারণেই ভারতবর্ষের ভূগর্ভস্থ সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ছিল বনাঞ্চলে। সভাবতই এসমস্ত ভূগর্ভস্থ প্রাকৃতিক সম্পদ, যেমন- কয়লা, লোহা, ম্যাঙ্গানিজ, অভ্র সহ নানাবিধ খনিজ সম্পদ উত্তোলনের ফলে অরণ্য ধ্বংস হয়েছিল অতি দ্রুত ও নির্বিচারে।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পর নানান কারণে, বিশেষ করে দেশভাগ ও বৈদেশিক আক্রমণ সহ নানা সমস্যায় জর্জরিত ভারত পরিবেশের ব্যাপারে বিশেষ ভাবার অবকাশ পায়নি। বিগত সত্তরের দশক থেকে পরিবেশ নিয়ে চিন্তাভাবনা হলেও রাষ্ট্রীয় প্রশাসকরা কখনোই পরিবেশ আইনগুলোকে যথাযথ কার্যকরী করেননি। তার ফলে বারংবার ভারতের সম্মানিত বিচারব্যবস্থা পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ব্রিটিশ আমল থেকে আদিবাসীরা জঙ্গল ধ্বংসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় এবং প্রাক্-স্বাধীনতা কালেও ভারতের যে কয়টি উল্লেখযোগ্য পরিবেশ আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, তার মূল চালিকাশক্তি ছিল প্রান্তিক মানুষের আন্দোলন। একুশ শতকে পরিবেশ নিয়ে নানাবিধ আলোচনা হলেও কার্যত পরিবেশ আইন কার্যকরী হয়নি। ফলে নদী দূষণ বেড়েছে, অরণ্য ধ্বংস হয়েছে, বন্যপ্রাণী কমেছে, বায়ু দূষণ বেড়েছে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা হয়নি, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পরিবেশ অপরাধ। কিন্তু পরিবেশ অপরাধ করা সত্ত্বেও কারোর কোনও শাস্তি হয়নি। কিছু দূষণমূল্য ধার্য করে তা রাষ্ট্রীয় কোষাগার স্ফীত করেছে; আর মাঝে মাঝে কিছু শিল্পকে সাময়িকভাবে দূষণের দায়ে বন্ধ করা হলেও পরবর্তীকালে তারা আবার দূষণ করেই উৎপাদন প্রক্রিয়া চালাচ্ছে।
এমতাবস্থায় সামনেই লোকসভা নির্বাচন এবং এখনই পরিবেশকর্মী তথা সমস্ত মানুষকেই সোচ্চারে বলতে হবে, যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় আসুক, তাকে দিতে হবে এক দুর্নীতিমুক্ত, পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন, তৎসহ দারিদ্র্যমুক্ত ভারতবর্ষ।
……………………………………………………………………………………………………………………………………
বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়, পরিবেশ ও সমাজকর্মী, চলভাষ- ৮৪২০৫২৯৯৬৬,
ই-মেল: biswajit.envlaw@gmail.com এবং রাহুল রায়, শিক্ষক ও পরিবেশ কর্মী,
চলভাষ- ৮৬১৭৭৪৫৩৪০, ই-মেল: rayrahul2263@yahoo.com
১১.০৩.২০২৪