
শুধু বই নয়, প্রকৃতিকে জানতে – বুঝতে গেলে যেতে হবে প্রকৃতির কাছে, মাথা রাখতে হবে প্রকৃতির কোলে — এই ভাবনাকে ভর করেই ‘বিজ্ঞান দরবার’ আয়োজন করেছিল তাদের এবছরের প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ শিবির। তাতে যোগ দিয়েছিল প্রায় ৩০০ ছাত্র–ছাত্রী ও প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ। আমিও এঁদের একজন। স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল নদিয়া’র হরিণঘাটার মোহনপুরে অবস্থিত রিভার রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা নদী বিজ্ঞান মন্দিরকে। ৩০ জন করে ১০টি দলে ভেঙে চলল প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ। আনন্দের ব্যাপার এই যে, যারা প্রকৃতি’র সঙ্গে আমাদের পরিচয় করাচ্ছিলেন তাদের কাছে জায়গাটি ছিল হাতের তালুর মতো চেনা। এখানকার জীববৈচিত্র্যের সবটাই তাঁদের নখদর্পণে। বহুবার তারা এখানে এসেছেন, সময় কাটিয়েছেন। ফলে সবুজের পথ ধরে এগোতে এগোতে চেনা জগৎ থেকে ক্রমশ অচেনা জগতের মাঝে আমরা বিচরণ করছিলাম। হাতে–কলমে চিনছিলাম ছোটো–বড় গাছ, ছত্রাক, পাখি, পোকা–মাকড়, জলাশয়ের জীববৈচিত্র্যসহ প্রকৃতির খুঁটিনাটি নানান বিষয়। দেখছিলাম পশ্চিমবঙ্গের ভূমিরূপের ওঠানামা ও দামোদরের জলপ্রবাহের চমৎকার সব মডেল। কিভাবে যে চারটি ঘন্টা কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। রিভার রিসার্চ ইনস্টিটিউট, মোহনপুর, হরিণঘাটা, নদিয়া।



সময়টা ১৯৪৩। দামোদরে সেবার ভয়াবহ বন্যা। ভেসে গেল হাজার হাজার ঘর। মারা গেল বহু মানুষ। নষ্ট হল একরের পর একর চাষের জমি। সমস্যা নিরসনে তড়িঘড়ি করে গঠিত হল ‘দামোদর বন্যা অনুসন্ধান কমিটি’। উদ্দেশ্য ছিল বন্যা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখা এবং ভবিষ্যতের বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেওয়া। জন্ম হল আমেরিকার টেনেসি ভ্যালি অথরিটির অনুকরণে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের। দামোদর বন্যা অনুসন্ধান কমিটি ও দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন – দুই উদ্যোগের সঙ্গেই সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন যে ব্যক্তি – তাঁর নাম মেঘনাদ সাহা। একই বছরে (১৯৪৩) তাঁর হাত ধরেই নদিয়া’র হরিণঘাটার মোহনপুরে গড়ে উঠল ভারতের প্রথম রিভার রিসার্চ ইনস্টিটিউট (নদী বিজ্ঞান মন্দির)।
নদীর ধারে বেড়ে ওঠা, পদ্মায় সাঁতার কাটা, বন্যাকে খুব কাছ থেকে দেখার ফলে নদীর কান্না ও নদীপাড়ের মানুষের দুঃখ সাহাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। ছাত্রাবস্থায় কলকাতার বন্যা (১৯১৩) হোক বা অধ্যাপনাকালে উত্তরবঙ্গের বন্যা (১৯২৩) — সবসময়েই তিনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। নদী ও নদীপাড়ের কষ্ট দূরীকরণের প্রাথমিক শর্ত যে নদী বিষয়ক পৃথক গবেষণাগার তৈরি, সেকথা দৃঢ়তার সঙ্গে বারেবারে বলেছেন। নদী গবেষণাগার স্থাপনের দাবী তুলে ধরেছেন ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশনে, প্রবাসী’র পাতায়, আচার্য প্রফুল্ল রায়ের স্মারকগ্রন্থে। আসলে তিনি চেয়েছিলেন বিদেশের মতো আমাদের দেশেও নদীর জলপ্রবাহ, নদীসংলগ্ন এলাকার মাটি, পরিবেশ–পরিস্থিতি, সেচ ব্যবস্থার ওপর প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ–বিশ্লেষণ–পর্যালোচনা করে তবেই বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেওয়া হোক।



প্রবাসী’র ১৩৪৪ পৌষ সংখ্যায় ‘দামোদর ক্যানাল’ প্রবন্ধে মেঘনাদ লিখছেন, “বাংলার নদীনালা দিয়া বৎসরে কত জলস্রোত প্রবাহিত হয়, দেশের উচ্চাবচতা কিরূপ ইত্যাদি বিষয়ে গভর্নমেন্টের সেচ–বিভাগের কোনো কর্মচারীদের কোন ধারণা বা জ্ঞান নাই। কিরূপভাবে বর্ত্তমানে খাল ইত্যাদি বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে কাটা হয়, তৎসম্বন্ধেও তাঁহাদের কোন জ্ঞান নাই। সুতরাং ব্যয় সাপেক্ষ কোন খাল ইত্যাদি খননের পূর্বে নদীবিজ্ঞান–সম্বন্ধীয় এক গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা, এবং নদীধৌত প্রদেশের জরিপ হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়। পূর্বে যে সমস্ত খাল খনন হইয়াছে, তাহাতে এইরূপ প্রণালী অবলম্বিত না হওয়াতে বহু কোটি টাকার অপব্যয় হইয়াছে। গবর্ণমেন্ট আমাদের নদীবিজ্ঞান সম্বন্ধীয় প্রস্তাবে সম্পূর্ণ উদাসীন আছেন। বাংলা দেশের নদী–নিয়ন্ত্রণ ও খাল খননের জন্য তাঁহারা সাধারণত পঞ্জাব হইতে বিলাতী ও পাঞ্জাবী এঞ্জিনিয়ার আমদানি করেন। ইহারা পাঞ্জাবের ব্যাপারে জানেন। কিন্তু বাংলার নদীনালার সমস্যা সম্পূর্ণ পৃথক। পঞ্জাবের এঞ্জিনিয়াররা তাহা না বুঝিয়াই কাজ আরম্ভ করেন ও সরকারের বহু টাকা লোকসান হয়। আমি এরূপ দু–একজন এঞ্জিনিয়ারকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম আপনারা নদী–নালার গতিবিধি, জলপ্রবাহের দিক ও পরিমাপ এবং দেশের উচ্চাবচতা সম্বন্ধে সম্যক অবগত না হইয়া কাজ আরম্ভ করেন কেন? তাঁহারা বলেন — আমরা কি করিব মহাশয়। উপরওয়ালারা তাগিদ লাগান যে কাজ দেখাইতে হইবে। সুতরাং যেন তেন প্রকারের কাজ করিতে হয়। …. আমার প্রস্তাবিত নদীবিজ্ঞান পরিষদে প্রথম খরচ হইত এককালীন ১০ লক্ষ টাকা এবং বাৎসরিক দুই লক্ষ টাকা। …. গবর্ণমেন্ট যদি নদীবিজ্ঞান পরিষদ করিয়া পূর্ণভাবে গবেষণা করিতেন তাহা হইলে এত টাকার অপব্যয় হইত না। আর একটি প্রয়োজনীয় তথ্য জানা দরকার — বাংলার নদীনালার সমস্যা কখনও ইংরেজ বা পাঞ্জাবী এঞ্জিনিয়ার দিয়া সমাধান হইতে পারে না, কারণ আরাম–কেদারা ছাড়িয়া দেশে গিয়ে জরীপ করা, বা তথ্য সংগ্রহ করার মতো ধৈর্য বা অবসর তাহাদের নাই। এই কাজের জন্য যে এঞ্জিনিয়ার দরকার তাহা বাংলা দেশেই সৃষ্টি করিতে হইবে।”



বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদীর নাব্যতারক্ষা, ভাঙনরোধ, সেচব্যবস্থার ক্ষেত্রে মোহনপুরের নদী বিজ্ঞান মন্দিরটি শুরুর কয়েক দশকে দারুণ সব পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু ৯০-এর দশকের পর থেকেই এর কাজ অনেকটাই স্থিমিত হয়ে আসে। বড় প্রকল্পগুলি এক এক করে বন্ধ হয়ে যায়। এর পিছনে অবশ্য নানাবিধ কারণ ছিল। প্রথম কারণ মথুরা বিল বুজে যাওয়া। দ্বিতীয় কারণ অর্থাভাব। তৃতীয় কারণ লোকবলের অভাব। প্রকৃতির নিয়মেই পুরোনো ঘর ও রাস্তাগুলি ঝোপঝাড়ে ঢাকা পড়ে। কিন্তু কথায় বলে, শেষ বলে যেন কিছু নেই আছে অবশেষ। একবারে থেমে না গিয়ে, নদী গবেষণার কাজ ধীর লয়ে চলতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেচ ও জলপথ বিভাগের অধীনে এই প্রতিষ্ঠানের বর্তমান কাজকর্ম দেখতে https://www.facebook.com/profile.php?id=100064533168809… এই লিঙ্কে ঘুরে আসুন।

– সুরাজ পাল, গবেষক।
লেখাটি খুবই সুন্দর হয়েছে। লেখক কে অনেক ধন্যবাদ।