
লিখেছেন: অনুপ হালদার
১৯৯২ সালে হেলসিঙ্কিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম আন্তঃসীমান্ত নদী নিয়ে কনভেনশন যা হেলসিঙ্কি কনভেনশন নামেও খ্যাত। উক্ত কনভেনশনে আন্তঃসীমান্ত নদীর যে সংজ্ঞা দেওয়া আছে সেটি হল দুই বা ততোধিক দেশের সীমান্ত অতিক্রমকারী ভূউপরস্থ ও ভূগর্ভস্থ জলপ্রবাহ ভিত্তিক যেসব নদনদী আছে সেগুলিই আন্তঃসীমান্ত নদী।
ভারত বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে ৫৪টি নদী প্রবাহিত। বাংলাদেশের পিউবো (পানি উন্নয়ন বোর্ড), ভারতীয় নদীমন্ত্রক এবং জাতীয় নদী কমিশন দ্বারা স্বীকৃত নদীর সংখ্যা ৫৪টি হলেও আমরা ক্ষেত্রসমীক্ষা করে জানতে পেরেছি যে এখন বর্তমানে ভারতের সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ৯৬টি নদী। বাংলাদেশ থেকে ৬টি নদী উৎপত্তি লাভ করে ভারতে প্রবেশ করেছে (বেরং, ভেরসা, তেঁতুলিয়া বা তুলাই, লোনা বা নোনা এবং ভাতা) অর্থাৎ ১০২টি নদী। এই ৬টি নদীর মধ্যে তেঁতুলিয়া বা তুলাই যৌথ নদী কমিশনের দ্বারা স্বীকৃত হলেও বাকি ৪টি নদী যৌথ নদী কমিশনের তালিকা বহির্ভূত। এছাড়াও চিরি নামক নদীটি দিনাজপুর জেলার বিরামপুর উপজেলা এলাকায় উৎপত্তি লাভ করে ভারতে প্রবেশ করেছে এবং পুনরায় ভারত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এরপর নওগাঁ জেলাধীন ছোট যমুনা নদীতে পতিত হয়েছে। তালিকা বহির্ভূত অপর একটি নদী (দিনাজপুর) যেটি স্থানীয় নাম ঘুকসি নামে পরিচিত। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যৌথ নদী কমিশনের তালিকা বহির্ভূত ৪৮টি নদীর মধ্যে ৪৪টি সরাসরি ভারতের সীমানা অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। নদীগুলি হল লুভা, শিলাইদহ, ফুলকুমার, হাড়িয়াভাঙা, চাওয়াই, গিদারি, কুরুম, পাঙ্গা, রেংখিয়াং, মাইনি, মালদাহা, সিমলাজান, কর্ণঝোরা, কর্ণবালজা, চেলা, জাফলং, ডাউকি, জালিয়াছড়া, দুধদা, নয়াগাঙজৈন্তাপুর, মহারাশি সোমেশ্বরী (ধর্মপাশা), সোমেশ্বরী-শ্রীবর্দি, ঘুংঘুর, ডাকাতিয়া, লহর, ঘুকসী, চিংগ্রী বা চেঙ্গী, যমনা পঞ্চগড়, সিংগিমারী, সাউ, সুই, হাড়িয়া, শ্রী নদী আর তালিকা বহির্ভূত অবশিষ্ট নদীগুলি বেরং, ভেরসা, লোনা ও ভাতা বাংলাদেশে উৎপত্তি হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে।
বিশেষতঃ মেঘালয়, গারো, খাসিয়া, জয়ন্তি পাহাড় ও মিজোরাম পাহাড় থেকে নেমে বাংলাদেশের দিকে বয়ে যাওয়া এমন অনেক নদীর সংখ্যা রয়েছে যেগুলির পূর্ণতালিকা প্রস্তুত হলে বা আমাদের সামনে এলে আন্তঃসীমান্ত নদীর সংখ্যা দ্বিগুণ হবে। এবার আসা যাক নদীর শাসন-এর কথায়। স্বাধীনতার এত বছর বাদেও আন্তর্জাতিক নদীগুলিকে স্বীকৃতি দেওয়া হল না কেন এটি একট বিরাট প্রশ্ন। আসলে অন্তর্জাতিক নদীগুলিতে যৌথনদী কমিশনের তকমা লেগে গেলেই আন্তর্জাতিক নদীনীতি বা জলনীতি মেনে চলতে হবে উভয় দেশকেই। (যদিও ভারত বা বাংলাদেশ কেউই এর তোয়াক্কা করে না দুটি দেশই তাদের নিজেদের ইচ্ছেমত নদীকে ব্যবহার করছে বাংলাদেশ ভাটির দেশ হওয়ার কারণে বেশিরভাগ নদী ভারতের পার্বত্য অঞ্চলে উৎপত্তি লাভ করে বাংলাদেশ হয়ে সাগরে মিশেছে। বেশ কিছু নদী বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশ করেছে।
ভারত থেকে প্রবাহিত ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদীর ওপরে আগেই ৪২টিতে স্থায়ী বা অস্থায়ী বাঁধ দিয়েছে ভারত। বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবাহিত ৬টি নদীর মধ্যে ৩টি নদীতে পাকাপাকি বাঁধ দিয়েছে বাংলাদেশ। বাকি তিনটি নদীর ক্ষেত্রে উৎসমুখই বিনষ্ট করে দিয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশের থেকে উৎপত্তি লাভ করে আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করে ভারত ভূখন্ডের বহুদূর পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে আবার বাংলাদেশে গিয়ে পড়েছে। এমন নদীর সংখ্যাও নেহাতই কম নয়। সেই নদীগুলির ক্ষেত্রে পুরো নদীটিই একেবারে দখল হয়ে গেছে। আসলে প্রবাহমান একটি জলধারা আদিঅনন্ত কাল ধরে সেটির বুকে এইভাবে বাঁধ দিলে একদিকে যেমন নদীর বহমানতা খর্ব হয় তেমনি নদীর বাস্তুতন্ত্র, জীববৈচিত্র্য, ভূগর্ভস্থ জলস্তর এর ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব পড়ে। ইতিমধ্যেই সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে পড়ছে। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা আর্সেনিক মালদা, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া প্রভৃতি জেলায় ইতিমধ্যেই ভূগর্ভস্থ জলস্তর মারাত্মক ভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে।
আন্তঃসীমান্ত নদী কোদালিয়া সীমান্তবর্তী জেলা উত্তর ২৪ পরগনা ভারত বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমানার থেকে বাংলাদেশের দিকে মাত্র ১৫০ মি: দূরে একটি স্লইস গেট নির্মাণ করে নদীকে কার্যত দুটি ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ নদীর বুকে বড় বড় বাঁধাল দিয়ে চিংড়ির ভেরি নদীসংলগ্ন বিলাঞ্চলগুলি ধানের জমিতে রূপান্তরিত হয়েছে। নদীটি বাংলাদেশে উৎপত্তি হলেও আন্তর্জাতিক সীমানার গা ঘেঁষে ৩/৪ বার সাপের মত এঁকেবেঁকে আবার বাংলাদেশে পড়েছে। নদীটির প্রায় ৬০ ভাগ দখল হয়ে গেছে বাংলাদেশের দিকে। ভারতের দিকে নদীর প্রশস্ততা ২৫০/৫০০ মি: এর মত হলেও বাংলাদেশের দিকে এর প্রশস্ততা ৫০/৭০ মি: এর মত।
সীমান্ত নদী সুরমা ও মাতৃনদী বরাক, ভারতের মনিপুর রাজ্যের তুইমই ও তুইরয় নদী দুটির মিলিত স্রোতধারার নাম বরাক এই নদী দুটির সঙ্গমস্থল থেকে প্রায় ৫০০ মি. পশ্চিমে মণিপুর রাজ্যের চুরাচাদপুর জেলার দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল টিপাই মুখে হাইড্রোইলেট্রিক বাধ নির্মাণ করেছে ভারত ফলে আন্তঃসীমান্ত নদী (২৪৯ কিমি.) কুশিয়ারা ২৮০ কিমি নদী দুটির মৃত্যু অনিবার্য।
good